মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি-১৮
গত আসরে আমরা যন্ত্রকৌশলবিদ্যায় মুসলমান বিজ্ঞানীদের অবদান নিয়ে খানিকটা কথা বলার চেষ্টা করেছি। বিশেষ করে বিশ্বব্যাপী গুরুত্ববহ মুসলিম বিজ্ঞানী জাযারির অনন্য আবিষ্কার নিয়ে কথা বলেছি। বলেছিলাম যে তিনি জলঘড়ি আবিষ্কার করেছিলেন, গভীর কুপ থেকে পানি উত্তোলনের যন্ত্রসহ আেো অনেক কিছু আবিষ্কার করেছিলেন।
আজো আমরা তারি ধারাবাহিকতায় কথা বলার চেষ্টা করবো।
হিজরী তৃতীয় শতকে মুসলিম বিশ্বে যন্ত্রকৌশলবিদ্যা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল, আর এ বিদ্যার সোনালী যুগ ছিল সপ্তম শতাব্দীর প্রথম পর্যায়। মুসলিম প্রকৌশলীগণ যান্ত্রিক সরঞ্জামাদি নির্মাণের ক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছিলেন। বিভিন্ন সরঞ্জাম তৈরির ক্ষেত্রে মুসলমান বিজ্ঞানীগণ স্টিল, লৌহজাত সামগ্রী, স্বর্ণ, রূপা, কাঠ, কাঁচ, চামড়া, তুলা, রেশমসহ আরো বহুরকম জিনিসপত্র প্রয়োজনমতো ব্যবহার করতেন। তবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হতো কাঠ এবং পাতলা তামা। তামার ব্যবহার পাইপ তৈরিসহ বিভিন্ন ডিজাইন তৈরির ক্ষেত্রে বেশি ব্যবহৃত হতো। মুসলিম বিজ্ঞানীগণ তার তৈরির জন্যে তামার ব্যবহার করতেন বেশি, তবে লোহার ব্যবহারও করতেন অনেক সময়। এই তার দিয়ে তাঁরা শেকল জাতীয় জিনিস তৈরি করতেন। গিয়ারহুইল কিংবা ববিন তৈরির ক্ষেত্রেও কাঠ বা তামা ব্যবহার করতেন।
ইসলামী সভ্যতার মাঝামাঝি সময়ে মুসলমানরা বিশেষ একটা সম্যসার মুখোমুখি হতেন। সেটা হলো কোনো কোনো এলাকায় উপরের দিকে পানি নেওয়ার সমস্যাটা ছিল প্রকট। পানি সমস্যার কারণে ঐসব এলাকার অধিবাসীদের খুব কষ্ট পোহাতে হতো। মুসলিম প্রকৌশলীগণ বিশেষ করে জাযারি এবং বনুমুসার মতো বিজ্ঞানীগণ বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি তৈরি করে পানি উপরের দিকে তোলার ব্যবস্থা করেছিলেন। তাদেঁর এই পদ্ধতি বা উদ্ভাবনীকে নাউরা বা চার্খ্ চহ্ বলে অভিহিত করা হতো, যার বাংলা দাঁড়াবে ‘চরকি কল'। মুসলিম বিশ্বের অনেক দেশেই এখনো পানি উপরে তোলার যন্ত্র এই চরকি কলের অস্তিত্ব খুজেঁ পাওয়া যাবে। বনুমুসার খান্দান ছিল যন্ত্রকৌশল বিদ্যায় সর্বপ্রথম পারদর্শী মুসলিম বিজ্ঞানী যাদেঁর মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বে এই বিদ্যার প্রসার ঘটে। বনুমুসার আলহিয়াল বইটি যন্ত্রকৌশল বিদ্যার ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম বই মুসলিম বিশ্বে যার নমুনা এখনো অবশিষ্ট রয়েছে। এই বইটিতে এক শ'টি যন্ত্রের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে যেগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করে।
বনু মুসা এবং তার ভাইদের বেশি কিছু আবিষ্কার আছে সেগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেসব যন্ত্র তাঁরা তৈরি করেছেন সেগুলোর মধ্যে রয়েছে খনন কাজে ব্যবহৃত যন্ত্র, বায়ুকে দূষণমুক্ত করার যন্ত্রসহ শ্রমিকদের জন্যে এবং পারিবারিক প্রয়োজনীয় বিভিন্ন যন্ত্র। মিল্লাং নামে গাড়ির একটি পার্টস আছে ইংরেজিতে যাকে ক্র্যাংক বলে, এটি সর্বপ্রথম আবিষ্কার করেছিলেন বনুমুসা। ইউরোপে আবিষ্কার হবার পাঁচ শ' বছর আগে তিনি এটি উদ্ভাবন করেছিলেন। জলপ্রবাহের শক্তি চালিত ঘড়িও তিনি আবিষ্কার করেছেন। এইসব ঘড়ি পরবর্তীকালে ইউেোপের বিভিন্ন গির্যা এবং স্কোয়ারে ব্যাপকভাবে ব্যভহৃত হয়েছে। এই ঘড়িগুলো নির্দিষ্ট সময়ে এলার্ম দিতো।
আবুল ফাত্হ আব্দুর রাহমান খযানি ছিলেন ইসলামী সভ্যতার যুগে বিখ্যাত একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী, পদার্থ বিজ্ঞানী এবং যন্ত্রকৌশল বিদ্যায় পারদর্শী একজন মুসলিম বিজ্ঞানী। খযানি ইবনে হিশাম এবং বিরুনীকে অনুসরণ করে যন্ত্রকৌশল বিদ্যায় ব্যাপক গবেষণা চালিয়ে অনেক অগ্রগতি লাভ করেছেন। ওজন মাপার যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন তিনি। খযানি একটি বই লিখেছিলেন মিযানুল হিকমা নামে। যন্ত্রকৌশলবিদ্যার ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বই। এ বইতে তিনি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করার আগে রাযি, বিরুনী, খৈয়্যাম প্রমুখের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন। সময় পরিমাপক যন্ত্র, বিভিন্ন রকম পাল্লা, বস্তুর ঘনত্ব পরিমাপক যন্ত্রসহ রেো অনেক যন্ত্রপাতি উদ্ভাবনীর বর্ণনা এই বইতে রয়েছে। ইতালির বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ অলদুমিয়ে লি বিরুনি এবং খযানির পরিমাপ পদ্ধতি এবং তাদের আবিষ্কারগুলোকে তুলনামূলক পর্যালোচনা করে বলেছেন তাদের যন্ত্র এবং পরিমাপ একদম সঠিক। শরীরের ওপর বায়ুর চাপের প্রভাব সম্পর্কে খযানি যথাযথ ধারণা দিয়েছেন।
ইবনে হিশাম নামে বহুল পরিচিত আবু আলী হাসান ইবনে হিশাম বাসরি ছিলেন হিজরী চতুর্থ শতাব্দীর একজন বিখ্যাত মুসলিম গণিতবিদ এবং পদার্থবিজ্ঞানী। মেকানিক এবং ফিযিক্সে তিনি মূল্যবান কিছু অবদান রেখেছেন। ইবনে হিশাম ছিলেন ফটোলজির জনক। ফটোলজি বিদ্যাকে তিনি সুশৃঙ্খল রূপ দেন। আলো নিয়ে এবং ছায়া নিয়ে তিনি ব্যাপক গবেষণা চালিয়েছেন। অন্ধকার কক্ষের বৈশিষ্ট্য নিয়েও তিনি অনেক গবেষণা করেছেন। একইভাবে তিনি আলোর প্রতিফলনের নিয়মের ক্ষেত্রে চমৎকার কিছু পর্যালোচনা করেছেন। সমতল বা কনভেক্স অর্থাৎ স্ফীত লেন্সকে বড়ো করে দেখানোর বিষয়টিকে পরিমাপ করেছেন। তাঁর লেখা বহু বই রয়েছে। ইউরোপীয় এবং মুসলমান গবেষকগণ ইবনে হিশামের লেখাগুলোকে অন্তত এক শতাব্দি আগে অনুবাদ করেন এবং প্রকাশ করেন।
ফটোলজি এবং পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ে ইবনে হিশামের গুরুত্বপূর্ণ অনেক বই এখনো পাওয়া যায়। তাঁর লেখা নুরুল মানাজির নামক বইটি ল্যাটিনে অনুদিত হবার পর সেই মধ্যযুগে এটি পশ্চিমা বিশ্বে ফটোলজি এবং পদার্থবিজ্ঞানের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। তবে ইবনে হিশামের পর মুসলিম বিশ্বে ফটোলজি বিদ্যা চর্চায় আগ্রহ কমে যায় এমনকি খাজা নাসিরুদ্দিন তূসির মতো বেো বড়ো মনীষীও ইবনে হিশামের অবদান সম্পর্কে ততোটা অবহিত ছিলেন না। তবে পরবর্তীকালে অর্থাৎ হিজরী সপ্তম শতাব্দিতে ফটোলজি নিয়ে পুনরায় চর্চা শুরু হয় এবং কুতুব উদ্দিন শিরাযি ফটোলজির একটি শাখাকে ইরানে ব্যাপকভাবে প্রবর্তন করেন। এই শাখাটি ফার্সি কুসও কাজাহ যার ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে রেইনবৌ অর্থাৎ রংধনু। আধুনিক পাশ্চাত্যে ফটোলজি নিয়ে যতোটা চর্চা হচ্ছে তা বহুলাংশেই ইবনে হিশামের মতো মুসলমান বিজ্ঞানীদের অবদানের কাছে ঋণী। এ কারণেই পাশ্চাত্যে ইবনে হিশামকে ফেোলজির জনক উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। বিখ্যাত বৃটিশ দার্শনিক ও বিজ্ঞানী রজার বেকনও পরিপূর্ণভাবেই ইবনে হিশামের প্রভাবে ভীষণরকম প্রভাবিত ছিলেন।#
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/আবু সাঈদ/১৫