আগস্ট ১৯, ২০১৭ ১৮:২০ Asia/Dhaka
  • মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি-১৯

গত আসরে আমরা গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞান এবং যন্ত্রকৌশলবিদ্যার মতোই বিষয়গুলোর গুরুত্ব নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছি। সেইসাথে এইসব বিদ্যায় মুসলমান বিজ্ঞানীদের অবদান নিয়ে খানিকটা কথা বলার চেষ্টা করেছি। আজকের আসরে চিকিৎসা বিদ্যায় মুসলিম চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীদের অবদান নিয়ে খানিকটা কথা বলার চেষ্টা বলবো।

চিকিৎসা বিদ্যা জ্যোতির্বিজ্ঞানের মতোই মুসলমানদের মাঝে জ্ঞানচর্চার প্রাথমিক পর্যায়েই গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হয় এবং এবং ব্যাপকভাবে মুসলমান মনীষীগণ চিকিৎসা বিজ্ঞানের চর্চা করেন। সমগ্র মুসলিম বিশ্বেই চিকিৎসা বিদ্যার ব্যাপক প্রচলন দেখা দেয়। একটি বর্ণনায় জ্ঞানকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে: একটি হলো এলমে আবদান অর্থাৎ দেহ বা স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিদ্যা, অপরটি হলো এলমে আদিয়ান। এই বর্ণনা থেকেই ইসলামে চিকিৎসা বিজ্ঞানের গুরুত্ব ও মর্যাদার বিষয়টি ফুটে ওঠে। চিকিৎসা বিদ্যার উন্নয়নে মুসলমানদের ব্যাপক গঠনমূলক ভূমিকা ছিল। অবশ্য চিকিৎসা বিষয়ক তাত্ত্বিক জ্ঞানের ধারণাগুলো মুসলমান বিজ্ঞানীদের কাছে এসেছিল অনুবাদের পথ ধরে। গ্রিক বিজ্ঞানীদের মূল্যবান গ্রন্থগুলো বিশেষ করে হিপোক্রেটিস এবং জালিনুসের বইগুলো অনুবাদ হবার ফলে এই বিদ্যায় মুসলমানদের তৎপরতার ধারা বেগবান হয়।

তবে মুসলমান চিকিৎসাবিজ্ঞানীগণ নিজেদের দেশে যেসব রোগ-ব্যাধির মুখোমুখি হয়েছেন, সেগুলোর চিকিৎসা ব্যবস্থাটা মুসলিম ভূখণ্ডের আঞ্চলিক পরিস্থিতি ও আবহাওয়ার আলোকে মুসলিম চিকিৎসাবিদগণই আবিষ্কার করেছেন।গ্রিক বিজ্ঞানীদের কোনো নির্দেশনা এক্ষেত্রে কাজে লাগে নি। যেমন ধরুন, জাকারিয়া রাযি তিনি তাঁর মহামূল্যবান গ্রন্থ আলহাভি'তে অন্তত ৭০০ প্রজাতির উদ্ভিদের ওষুধিগুণ বর্ণনা করেছেন। অথচ গ্রিক বিজ্ঞানী দিউসকুরিদস তাঁর বইতে মাত্র ৫০০ টি ওষুধি উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসের ক্ষেত্রে আলহাভি গ্রন্থটি একটি আকর গ্রন্থ। এ বইটিতে বেশ কিছু রোগ-ব্যাধি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। রাযির আলহাভি বইয়ের বিভিন্ন অধ্যায়ে যেসব রোগব্যাধি নিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয়েছে কিংবা সেসব রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সেগুলো গ্রিক চিকিৎসাবিদ জালিনুস কিংবা হিপোক্র্যাটিসের বইয়ের চেয়ে অনেকগুণ বেশি এবং স্বতন্ত্র।

চিকিৎসাবিদ্যা ইসলামী যুগে ভারত এবং গ্রিক চিকিৎসাশাস্ত্রগুলো অনুবাদের মধ্য দিয়ে বিস্তৃতি পায়। খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে রোম সরকার প্রাচীন কনস্টান্টিনোপলের খ্রিষ্টান ধর্মনেতা নাস্তুরের অনুসারীদেরকে তাদের সাম্রাজ্য থেকে বের করে দিয়েছিল। তারপর নাস্তুরিরা ইরানে আসে এবং জন্দিশাপুরে তারা তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্র স্থাপন করে। জন্দিশাপুরে তারা চিকিৎসা বিদ্যালয় স্থাপন করে এবং সেখানেই তারা গ্রিক চিকিৎসাবিদ্যা আর ভারতীয় চিকিৎসাবিদ্যার সংমিশ্রণ ঘটায়। পরবর্তীকালে এই চিকিৎসা বিদ্যালয় থেকে বহু চিকিৎসক তৈরি হয় যারা ইসলামী চিকিৎসার উন্নয়ন এবং চিকিৎসাকেন্দ্র বা হাসপাতালের উন্নয়নের ক্ষেত্রে ব্যাপক গঠনমূলক ভূমিকা রাখে। আসলে ইসলামী যুগে চিকিৎসাবিদ্যার বিস্তৃতির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদানের অন্যতম একটি নিদর্শন হলো এই জন্দিশাপুর চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা। জন্দিশাপুর চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও এখানে ছিল গুরুত্বপূর্ণ একটি হাসপাতালও। জন্দিশাপুর হাসপাতালটি ইরানের প্রাচীনতম চিকিৎসাকেন্দ্র। দ্বিতীয় শাপুরের শাসনামলে এই হাসপাতালটির অস্তিত্ব ছিল।

জন্দিশাপুর হাসপাতালটির কার্যক্রম ইরানী চিকিৎসক এবং প্রফেসরদের উদ্যমে এবং তৎপরতায় তিনটি শতাব্দী ধরে চলমান ছিল। এটিই ছিল ইসলামী সভ্যতার যুগে সর্বপ্রথম চিকিৎসাকেন্দ্র। জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার এই কেন্দ্রে সমকালীন শ্রেষ্ঠ ও বিখ্যাত ডাক্তারগণ ছাত্রদের পড়াতেন এবং রোগীদের চিকিৎসা করতেন। জোন্দিশাপুরে যেই খান্দানটি চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নয়নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন সেই খান্দানটি হলো বাখতিশু। এই খান্দানের বারোজন সদস্য কয়েক প্রজন্মের জন্যে অর্থাৎ হিজরি দ্বিতীয় শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে হিজরি পঞ্চম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত খলিফাদের উপদেষ্টা এবং চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং চিকিৎসা সংক্রান্ত বই পুস্তক অনুবাদের কাজেও নিয়োজিত ছিলেন। এরা আব্বাসীয় খলিফাদের দরবারে চিকিৎসক হিসেবে, উপদেষ্টা হিসেবে এবং নতুন কোনো বই-পুস্তক কিংবা কোনো লেখা এলে সেগুলো অনুবাদ করতেন। বারমাকিয়ানও বাগদাদে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নিজের নামে। তবে এই হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন ইবনে দেহ্‌ন নামের এক ভারতীয় চিকিৎসকের ওপর। তাঁরা ভারতীয় ঐ চিকিৎসককে সংস্কৃত ভাষার চিকিৎসাশাস্ত্রগুলোকে আরবি ভাষায় অনুবাদ করার আহ্বান জানান। এই হাসপাতালটির খ্যাতির ফলে অনুরূপ আরো বহু হাসপাতাল গড়ে ওঠে।

আব্বাসীয় খেলাফতের শুরুর দিকে বাদশাহদের দৃষ্টি ছিল প্রাচীন সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং চিকিৎসাবিদ্যার প্রতি বিশেষ করে গ্রিক বিদ্যার প্রতি। হিজরি ১৪৮ সালে আব্বাসীয় খলিফা মানসুর নিজের রোগের কারণে বাখতিশুকে বাগদাদে ডেকে পাঠান। বাখতিশু খলিফার চিকিৎসা করেন এবং তারপর থেকে তিনি খলিফার সুনজরে পড়ে যান। বাখতিশু খান্দানের পরবর্তী প্রজন্মও বাগদাদে বসবাস করেন। অনুবাদের কাজ যখন উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে করা হয় তখন ধীরে ধীরে পূর্ব রোম, গ্রিক ডাক্তারদের চিকিৎসা পদ্ধতিকে কাজে লাগানোর সুযোগ হয়।

গ্রিসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেসব বই আরবি ভাষায় অনুদিত হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে দিউসকুরিদস এর বই। হিজরি তৃতীয় শতাব্দীর শুরুতে বায়তুল হিকমা ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার ফলে চিকিৎসা বিষয়ক বইপত্র অনুবাদের ক্ষেত্রে বহু জ্ঞানী গুণী আত্ম-নিয়োজিত হন। সবচেয়ে বেশি অনুবাদ করেছিলেন যিনি তাঁর নাম হলো হুনায়ন্ ইবনে ইসহাক আব্বাদি। হুনায়ন প্রায়ই অনূদিত বইগুলোকে অন্যদের সহযোগিতায় বিশেষ করে তাঁর ছেলে ইসহাকের সহযোগিতায় সুরিয়ানী এবং আরবি ভাষায় অনুবাদ করতেন।

মৃত্যুর আগে তিনি বলেছিলেন জালিনুসের ৯৫টি বই সুরিয়ানী ভাষায় অনুবাদ করেন এবং ৩৪টি বই আরবি ভাষায় অনুবাদ করেন। না, কেবল অনুবাদই নয় বরং তিনি মৌলিক গ্রন্থও লিখেছেন চিকিৎসা বিষয়ে। তাঁর বিখ্যাত বইগুলোর মধ্যে আল-মাসায়িলু ফিত্তিব্বিল মুতায়াল্লিমিন ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছিল। চক্ষু চিকিৎসার ব্যাপারেও তিনি মৌলিক একটি বই লিখেছেন আলআশরু মাকালাতি ফিল আইন নামে। এভাবেই চিকিৎসাবিদ্যায় মুসলমান মনীষীগণ ব্যাপক অবদান রেখেছিলেন। চিকিৎসাবিদ্যায় আরো যে কজন ব্যক্তিত্বের নাম অবশ্যই উল্লেখ করার মতো তাদের মধ্যে একজন হলেন আবুল হোসাইন আলি বিন সাহাল রাবান তাবারি। তিনি একটি বই লিখেছিলেন ফিরদাউস আল হিকমা নামে।

এ বইতে তিনি ভারতীয়, গ্রিক এবং রোমের চিকিৎসা পদ্ধতির বর্ণনা দেন। জালিনুস এবং হিপোক্রেটিসের দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতেই হিজরি তৃতীয় শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত চিকিৎসা বিষয়ক জ্ঞান চর্চা হতো, তবে এই শতকেই তিব্বুন নববী নামে নতুন একটি বইয়ের প্রকাশ ঘটে যেটি লিখেছিলেন আলেমগণ। নবীজীর প্রদর্শিত এবং আলকোরআনে বর্ণিত নিদর্শনা অনুযায়ী এবং রাসূলে খোদার দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী ঐ বইটি লেখা হয়। তিব্বুল আয়িম্যা নামেও আরেকটি বই লেখা হয়েছিল এ সময়। এভাবেই চিকিৎসা বিজ্ঞানে মুসলমানরা অবদান রেখেছিলেন।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/আবু সাঈদ/১৯