মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি-২৫
মুসলমান রসায়নবিদ এবং বিজ্ঞানীদের মধ্যে রসায়নবিদ্যার ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রেখেছেন এরকম আরেকজন বিশিষ্ট মনীষী হলেন মুহাম্মাদ ইবনে যাকারিয়া রাযি।
রাযির জীবনকাল হলো হিজরী তৃতীয় শতাব্দির দ্বিতীয়ার্ধ এবং চতুর্থ শতাব্দির প্রথমার্ধ। মুসলমানদের মাঝে সবচেয়ে বড়ো ক্লিনিক্যাল পিজিশিয়ান হিসেবে তাকেঁ মনে করা হয়। চিকিৎসাবিদ্যায় পড়ালেখা করার আগে তিনি ছিলেন একজন রসায়নবিদ। সে সময় তিনি চেষ্টা করেছেন এমন একটি বস্তু আবিষ্কার করতে যার সাহায্যে সস্তা ধাতুকে মূল্যবান ধাতু বিশেষ করে সোনায় পরিণত করা যায়।
যুবক বয়সের চঞ্চলতা কাটিয়ে একসময় তিনি রসায়নবিদ্যায় গভীরভাবে মনোযোগ দেন এবং এই বিদ্যায় শেষ পর্যন্ত তিনি ব্যাপক পাণ্ডিত্য লাভ করেন। রসায়নবিদ্যার উন্নয়নের জন্যে তিনি কঠিন কঠিন বহু রকমের পরীক্ষা নিরীক্ষা চালান। ব্যাপক জটিল এবং কঠিন পরীক্ষার ফলে তিনি তাঁর দুটি চোখ হারান এবং দৃষ্টিশক্তি হারাবার ফলে রসায়নবিদ্যা নিয়ে গবেষণা আর চালাতে পারেন নি।
রাযি নিজেকে জাবের ইবনে হাইয়্যানের ছাত্র বলে মনে করতেন। রসায়নবিদ্যায় জাবেরি সংকলনের মতো রাযিরও বহু সৃষ্টিকর্ম রয়েছে। রসায়নের রহস্যময় বিভিন্ন দিককে উপেক্ষা করে রাযি রসায়নকে আধুনিক রূপ দান করেন। তিনি যেসব বই পুস্তক লিখে গেছেন কিংবা যেসব দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করে গেছেন রসায়ন সম্পর্কে তা এই বিষয়ে তাঁর সর্বপ্রথম সৃষ্টিকর্ম।
রসায়নবিদ্যার দৃষ্টিতে দেহের যথাযথ স্তরবিন্যাস রাযির একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান। তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য অবদান হচ্ছে সেররুল আসরার নামক বিখ্যাত গ্রন্থ। সমগ্র বিশ্বেই তাঁর এই গ্রন্থটি ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। রসায়নের ক্ষেত্রে রাযির এই গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টি রসায়ন বিজ্ঞানের পরিভাষার আলোকে লেখা হয়েছে। গ্রন্থটিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পদ্ধতি,বস্তু এবং ধাতুর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য, রাসায়নিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
রাযি তাঁর সেররুল আসরারসহ বিভিন্ন গ্রন্থে রসায়নের ক্ষেত্রে যেসব সরঞ্জাম ব্যবহৃত হয় সেসব সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। সেগুলোর মধ্য থেকে বহু সরঞ্জাম রসায়নবিদ্যায় এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, রাযির সেররুল আসরার গ্রন্থটি তাঁর এক হাজার একশ'তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ইরানের ইউনেস্কোর জাতীয় কমিশনে গৃহীত হয়েছে। রাযির এই গ্রন্থটিও তাঁর অপরাপর গ্রন্থের মতোই আরবি ভাষাতে ছাপা হয়েছে। রাযি যেহেতু একজন অনন্য সাধারণ মনীষী ছিলেন সেজন্যে তিনি রসায়নের রহস্যময় অনেক বিষয়ের সাথেই দ্বিমত পোষণ করেছেন। তিনিই সর্বপ্রথম ব্যক্তি যিনি রাসায়নিক সামগ্রীকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করেছেন-খনিজ, ভেষজ এবং প্রাণ রসায়ন।
এই তিনটি বিভাগকেই তিনি পৃথক পৃথকভাবে আলোচনা করেছেন। তিনিই বলেছিলেন,সপ্রাণ প্রতিটি বস্তু যে সচল তার কারণ হলো রাসায়নিক জটিল বিক্রিয়া বা প্রতিক্রিয়া। সালফিউরিক এসিড এবং অ্যালকোহল তাঁর গুরুত্বপূর্ণ দুটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার। যাকারিয়া রাযির বৈজ্ঞানিক অর্জনগুলো রসায়নবিদ্যার জগতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছিল।
আলকেমিকে কেমিস্ট্রি বা রসায়নবিদ্যায় পনিণত করার ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম যিনি কাজ শুরু করেছিলেন তিনি হলেন যাকারিয়া রাযি। রাযি যেহেতু রসায়নবিদ্যা পর্যালোচনা পদ্ধতি নিয়ে সর্বপ্রথম কাজ করেছেন সেদিক থেকে বিচার করলে তাকেঁই রসায়নবিদ্যার প্রতিষ্ঠাতা বলা যেতে পারে। জার্মানির বিখ্যাত রসায়নবিদ ডক্টর ইউলিডস রুসকা রাযির সৃষ্টিকর্মের ওপর গবেষণা চালিয়েছেন। তিনি লিখেছেনঃ রাযি প্রথমবারের মতো রসায়নবিদ্যার ক্ষেত্রে নতুন একটি মতবাদ চালু করেছেন যাকে বলা যায় তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক রসায়ন।রাযিই সর্বপ্রথম রসায়নবিদ যিনি রাসায়নিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াকে চিকিৎসাবিদ্যায় কাজে লাগিয়েছেন। এরফলে চিকিৎসাক্ষেত্রে যে সেবাটি তিনি দিয়ে গেছেন তা এক কথায় অনন্য।
সমগ্র মানবজাতি আজো তা থেকে ব্যাপকভাবে উপকৃত হচ্ছে। পরবর্তীকালে চিকিৎসার রাসায়নিক পদ্ধতি অনুসরণ করেন ইবনে সিনা। হিজরি চতুর্থ শতকে ইবনে সিনা এবং ফারাবির মতো বিজ্ঞানীগণ রসায়নবিদ্যা, এক্সিরসহ রসায়নবিজ্ঞানের বিভিন্ন দিক নিয়ে ব্যাপক গবেষণা চালান। এছাড়াও হিজরি পঞ্চম শতকে কাসি নামে পরিচিত আবুল হাকিম সালেহি খাওয়ারেযমি রসায়নবিদ্যা সম্পর্কে আওনুস সানা নামে একটি পুস্তিকা লেখেন। আলকেমির বিভিন্ন সরঞ্জাম সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বইটিতে।
আবুল কাসেম ইরাকি হিজরী সপ্তম শতাব্দির অপর একজন স্বনামধন্য রসায়নবিদ। রসায়নবিদ্যার ওপর তিনি বেশ লেখালেখি করেছেন। রসায়নবিদ্যা সংক্রান্ত তাঁর লেখা বহুল পরিচিত একটি বই হচ্ছে আলমাকতাসাবু ফি যেরাআতিজ জাহাব। ইরাকিও ছিলেন জাবের ইবনে হাইয়্যানের ছাত্র। তাই তাঁর যতো লেখালেখি কিংবা দৃষ্টিভঙ্গি তা জাবেরের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসৃত বলা চলে।
সেজন্যে তাঁর নিজস্ব কোনো নতুন দৃষ্টিভঙ্গি বা উদ্ভাবনী ছিলো না। তিনি বরং পরিপূর্ণ নিষ্ঠার সাথে তাঁর রসায়নের শিক্ষকদেরই অনুসরণ করেছেন। বলা যেতে পারে শিক্ষকদের রেখে যাওয়া পথেই চলেছেন তিনি। ইরাকির মতো রসায়নবিদ রসায়নের ঐশি উৎসে বিশ্বাসী ছিলেন। এজন্যে তিনি রসায়নের মূলনীতিগুলো সংরক্ষণের ব্যাপারে ছিলেন খুবই যত্নবান। জাবের ইবনে হাইয়্যানের অনুসরণে ইরাকি সকল ধাতুকে একক ইউনিট বলে মনে করতেন এবং এগুলোর মাঝে পার্থক্যকে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য বলে মনে করতেন। তিনি এই শ্রেণীর ধাতুকে ভেষজ এবং প্রাণীজ বৈচিত্র্যের সাথে তুলনা করতেন।
মুসলমান রসায়নবিদগণ বস্তুর ওপর ব্যাপক পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়েছেন। এই পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে তাঁরা ডিস্টিলেশান,ভ্যাপোরাইজেশান, সাবলিমেশান, মেল্টিং, ক্রিস্টালাইজেশান এবং ফ্রিজিং ইত্যাদি বিষয়ের সাথে পরিচিত হয়েছে। এভাবে তাঁরা রসায়নের বিচিত্র বস্তুও আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন।এভাবেই মুসলমান রসায়নবিদগণ রসায়ন বিদ্যার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অনেক অবদান রেখে গেছেন, যা আধুনিক ঔষধ বিজ্ঞান এবং রসায়নবিদ্যার ভিত্তিভূমি রচনা করেছে। মুসলিম বিশ্বে তাঁদের সেইসব অবদান বিশেষভাবে গৃহীত হয়েছে।#
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/আবু সাঈদ/৭