সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১৭ ২১:১৩ Asia/Dhaka
  • মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি-২৯

হিজরি চতুর্থ শতাব্দি রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং জ্ঞান ও বিজ্ঞানের দিক থেকে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি শতাব্দি। একদিকে ইসলামের ইতিহাসে এই যুগটি রাজনৈতিক এবং সামাজিক বিরোধের যুগ,অপরদিকে বিদ্যা-বুদ্ধি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, নীতি ও অলঙ্কার শাস্ত্রের উন্নয়ন ও বিকাশের যুগ।

প্রকৃতপক্ষে এই সময়ে মুসলিম বিশ্বের মাঝে জ্ঞান ও বিজ্ঞানগত যোগাযোগ ব্যাপক বৃদ্ধি পায় এবং তাত্ত্বিক ও মননশীল লেখালেখির কারণে ব্যাপক পরিবর্তন আসে।এই যুগের শিল্প ও সাহিত্যকর্মগুলোই তার প্রমাণ। এই পরিস্থিতিতে মুহাম্মাদ বিন আবি জার ইউসুফ আমেরি নিশাবুরি নামের বিখ্যাত একজন মুসলমান মনীষী ও দার্শনিকের আবির্ভাব ঘটে। অবশ্য আবুল হাসান আমেরি নামেই তিনি বেশি পরিচিত। আমেরি নিশাবুরে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং সেখানেই তিনি ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করেন।

তিনি বিশ্বের যেখানেই গেছেন সেখানকার জ্ঞান ও বিজ্ঞানগুলো আয়ত্ত্ব করার চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছেন এবং বড়ো বড়ো জ্ঞানী-গুণীদের সাথে জ্ঞানগত বিষয় আশয়ে আলাপ-আলোচনা করেছেন। আমেরি দর্শন বিদ্যা শিখেছেন তাঁর শিক্ষক আবু যায়েদ বালখির কাছে। তাঁর শিক্ষাগুরুর মৃত্যুর পর তিনি বাগদাদে যান এবং পুনরায় সেখান থেকে দেশে ফিরে যান। আমেরি রেই শহরে আলে বুইয়ের দরবারে কাটান এবং ইবনে মুসকোভিয়ের মতো বিখ্যাত দার্শনিকের পৃষ্ঠপোষক এবং প্রেরণাদাতা ছিলেন।

দর্শনের ক্ষেত্রে আবুল হাসান আমেরি গুরুত্বপূর্ণ বহু দৃষ্টিভঙ্গি ও তত্ত্ব রেখে গেছেন। তিনি সবচেয়ে বেশি চেষ্টা করেছেন প্রমাণ করতে যে দর্শন বিভিন্ন জ্ঞানের জন্যে এবং বিশেষ করে ঐশি জ্ঞানের জন্যে সবচেয়ে বেশি সুবিধাজনক। সত্যে উপনীত হবার জন্যে ইসলাম এবং দর্শন খুবই অনুকূল এবং পরিপূরক। তিনি একজন দার্শনিক তো বটেই এর বাইরেও তিনির ছিলেন একজন ভালো লেখক। দর্শন নিয়ে তিনি বেশ কিছু মূল্যবান বই লিখেছেন। ধর্ম এবং নীতিনৈতিকতা নিয়েও বেশ কিছু মূল্যবান বই লিখেছেন তিনি।

ওহী এবং বুদ্ধি সংক্রান্ত বিতর্ক সম্পর্কে তিনি যে গুরুত্বপূর্ণ একটি দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছেন তা বিস্তারিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ সহকারে লিখিত হয়েছে তাঁর ‘আলএ'লামু বিমুনাকিবিল ইসলাম' নামক বইতে। এই বইতে দার্শনিক আমেরি ইসলাম ধর্মের অবস্থান এবং উচ্চ মর্যাদা সম্পর্কেও কথা বলেছেন, সেইসাথে ঐশী এই ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কেও যুক্তিপূর্ণ বর্ণনা দিয়েছেন। তাঁর সমকালীন বহু দার্শনিক ও শিক্ষক এই গ্রন্থটিকে সহজ সাবলীলতা ও বর্ণনার পদ্ধতিগত দিক থেকে বিরল বলে মন্তব্য করে বলেছেন-এই ধরনের বা পদ্ধতির বই তাঁর আগে আর লেখা হয় নি।

এই বইতে আমেরি দ্বীনী জ্ঞানগুলোকে সাধারণ জ্ঞানের ওপরে স্থান দিয়েছেন। বিভিন্ন ধর্মের মাঝে তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে ইসলাম তার অভীষ্ট লক্ষ্যে সাফল্যের সাথে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে। তাঁর দৃষ্টিতে নবী রাসুলগণ হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক। এমনকি মানবীয় জ্ঞান-বুদ্ধি ও প্রজ্ঞাও ঐশী আধ্যাত্মিকতার মূল্য ও গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টিকে প্রামাণ্য করে তুলছে। মানুষের মৃত্যু পরবর্তী জীবন সম্পর্কেও আবুল হাসান আমেরি একটি বই লিখেছেন ‘আল আমাদু আলাল আবাদ' নামে।

এই গ্রন্থে তিনি দোযখ এবং বেহেশ্‌ত সম্পর্কে কোরআনের বক্তব্যগুলোকে এ বিষয়ক দার্শনিক বিশ্লেষণের জন্যে একান্ত জরুরি বলে মনে করেন। মুসলিম এই মনীষী দর্শনের বৈশিষ্ট্য এবং মানুষের ইচ্ছা সম্পর্কেও বহু আলোচনা করেছেন তাঁর বইতে। আবুল হাসান আমেরির দৃষ্টিতে পরিপূর্ণতম মানুষ তিনিই যিনি সত্য সম্পর্কে অন্যদের চেয়ে বেশি সচেতন এবং বাস্তব জীবনেও সত্যের ওপর সবার চেয়ে বেশি অটুট। এ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য হলোঃ ‘মানুষের জন্যে যা নির্দিষ্ট অর্থাৎ যে বিষয়টি কেবল মানুষের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য বলে গণ্য তাহলো সত্যকে চেনা এবং সে অনুযায়ী সকল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা।'

নিজেকে চেনার বিষয়টি মানুষের একটি আদি প্রশ্ন। মানুষের গুণবৈশিষ্ট্য তার স্বভাব-প্রকৃতি ও পরিচয় ইত্যাদি নিয়ে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই চিন্তাবিদ মনীষীগণ ভেবেছেন। আবুল হাসান আমেরি ‘আস্‌সায়াদা ওয়াল আসয়াদ ফিস সিরাতিল ইনসানিয়া' নামক গ্রন্থে সৃষ্টির উদ্দেশ্য, শ্রেষ্ঠত্বের প্রকার, পূর্ণতা অন্বেষণ, মানুষের সামাজিকতা ও সৌভাগ্যকামিতা ইত্যাদি বিতর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন। আমেরির দৃষ্টিতে খলিফা অর্থাৎ আল্লাহর স্থলাভিষিক্ত তিনিই যাঁর মূল্যবান অস্তিত্বে সর্বপ্রাথমিক আত্মিক মূল্যবোধগুলো এবং দৈহিক শ্রেষ্ঠত্বের বৈশিষ্ট্যগুলো বিদ্যমান।

মুসলিম বিশ্বের আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ মনীষী হলেন আহমাদ বিন মুহাম্মাদ বিন ইয়াকুব। তাঁর উপাধি ছিল ইবনে মুসকোভিয়ে। তিনি একাধারে একজন দার্শনিক, একজন ইতিহাসিবিদ, একজন চিকিৎসাবিজ্ঞানী এবং একজন নামকরা ইরানী সাহিত্যিক ছিলেন। তাঁর জন্মতারিখ হিজরি ৩২০ থেকে ৩৩০ এর মধ্যে বলে মনে করা হয়। ইবনে মুসকোভিয়ে ইরানের রাজধানী তেহরানের নিকটবর্তী রেই শহরের অধিবাসী ছিলেন। তাঁর খান্দান ছিল জরথ্রুস্ট ধর্মের অনুসারী। এই বংশটি ইবনে মুসকোভিয়ের পিতার সময় থেকে কিংবা ইবনে মুসকোভিয়ের সময় থেকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল। ইবনে মুসকোভিয়ে যে-কোনো মুসলিম চিন্তাবিদের চেয়ে ইসলামী নৈতিকতা সম্পর্কে অনেক বেশি আগ্রহ দেখিয়েছেন। নৈতিক দর্শনের ক্ষেত্রে তিনি অবশ্য এরিস্টটলের অনুসারী ছিলেন। অবশ্য ইবনে মুসকোভিয়ে কোনো কোনো বিষয়ে প্লেটোর দৃষ্টিভঙ্গিকেও অনুসরণ করতেন। এসবের বাইরেও তিনি তাঁর নিজস্ব দর্শনের ক্ষেত্রে ইসলামী শরিয়তের প্রভাবে প্রভাবিত ছিলেন।

বিখ্যাত এই মনীষী মূল্যবান বহু সৃষ্টিকর্ম রেখে গেছেন জ্ঞানের ভূবনে। নীতি দর্শনের ক্ষেত্রে তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বইটি হলো ‘তাহজিবুল আখলাক'। হিজরি সপ্তম শতাব্দির খ্যাতনামা মনীষী নাসিরুদ্দিন তূসি এই গ্রন্থের বহু বক্তব্যকে তাঁর নিজস্ব গ্রন্থ ‘আখলাকে নাসেরি'র প্রথম অধ্যায়ে তুলে ধরেছেন।

ইবনে মুসকোভিয়ের নীতি দর্শন বিষয়ক আরেকটি মূল্যবান গ্রন্থ হলো ‘প্রজ্ঞার অমরত্ব'। এই গ্রন্থে তিনি ইরানী, ভারতীয়, আরব এবং গ্রিক চিন্তাদর্শ এবং হিতোপদেশগুলোকে একত্র সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন। দিকনিদর্শন বা উপদেশমূলক দিকটির কারণে এই সংকলনে দার্শনিক দিকটি কম গুরুত্ব পেয়েছে। ইবনে মুসকোভিয়ের আরেকিটি গুরুত্বপূর্ণ বই হলো ‘তাহজিবুল আখলাক'।এই গ্রন্থের আলোচ্য বিষয় সাতটি।দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয় এতে আলোচিত হয়েছে। এরিস্টটল এবং প্লেটোর দৃষ্টিভঙ্গিগুলোও আলোচনা প্রসঙ্গে উঠে এসেছে।বিচিত্র বিষয়ে লেখালেখির পর অবশেষে ইরানী বিখ্যাত দার্শনিক ইবনে মুসকোভিয়ে ৪২১ হিজরি অর্থাৎ ১০৩০ খ্রিষ্টাব্দে ইস্ফাহানে মৃত্যুবরণ করেন।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/আবু সাঈদ/১৯