অক্টোবর ০৫, ২০১৭ ২০:৫০ Asia/Dhaka
  • মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি-৩০

হিজরী চতুর্থ শতকে ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও দার্শনিকদের একটি দল গঠিত হয়। দলটির নাম ছিল ‘এখওয়ানুস সাফা'।এই গোষ্ঠিটির সবাই ছিলেন মুসলমান।

তাঁরা গোপনে গোপনে বসরা এবং বাগদাদে দলটি গঠন করেন। তাঁদের লক্ষ্য ছিলো মুসলমানদের মাঝে দর্শনের প্রচার ও প্রসার ঘটানো। ইসলামের সাথে যেসব বিকৃত বিষয় আশয়ের মিশ্রণ ঘটানো হয়েছিলো সেগুলোকে দূর করার মধ্য দিয়ে সমাজকে বিশুদ্ধ করাই ছিলো তাদের উদ্দেশ্য। বিখ্যাত ফরাশি দার্শনিক হ্যানরি কুরবান এখওয়ানুস সাফার অনুবাদ করেছেন ‘একনিষ্ঠ ভাই এবং বিশ্বস্ত বন্ধু'। এখওয়ানুস সাফার চারটি স্তর বা শ্রেণী ছিল। প্রথম শ্রেণীটি ছিল প্রাথমিক পর্যায়ের। যাদের বয়স পণেরো থেকে ত্রিশ বছরের মধ্যে ছিলো এবং যারা তীক্ষ্ম বুদ্ধিসম্পন্ন তারাই ছিল প্রাথমিক পর্যায়ের।এই শ্রেণীটি ছিল ‘সৎকর্মশীল দয়ালু ভ্রাতৃগোষ্ঠি' নামে পরিচিত। দ্বিতীয় শ্রেণীটি ছিল ত্রিশ থেকে চল্লিশ বছর বয়সের। এঁরা পরিচিত ছিলেন ‘সৎকর্মশীল জ্ঞানী ভ্রাতৃগোষ্ঠি' নামে। দানশীলতা,বদান্যতা,দয়া,আন্তরিকতা, বিশ্বস্ততা ইত্যাদি ছিল তাঁদের গুণবাচক পরিচয়।

তৃতীয় শ্রেণীটি ছিলো চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ বছর বয়সের মধ্যে। এই শ্রেণীটির উপাধি ছিল ‘ফাজেলে কারিম' অর্থাৎ সুশিক্ষিত মহানুভব। এই শ্রেণীর দার্শনিকগণ আইন কানুন বা বিধি বিধানগুলো খুব ভালো করে জানতেন,আকায়িদ সম্পাদনা করতেন এবং বিভিন্ন অধিকার রক্ষা করতেন। আর চতুর্থ শ্রেণীটি ছিল পঞ্চাশ বছরের উর্ধ্বে যাদেঁর বয়স ছিলো-তাঁরা। এই শ্রেণীটি ছিল সেইসব উচ্চ পর্যায়ের মনীষীদের যাঁরা দার্শনিক হিসেবে পরিপূর্ণতায় পৌছেঁ গেছেন। এখওয়ানুস সাফা সংস্থার সদস্যরা ছিলেন সমকালে প্রচলিত সকল রকমের বিদ্যায় পারদর্শী। একইভাবে তাঁরা ধর্মীয় বিষয় আশয়, বিভিন্ন জাতির ইতিহাস, বিভিন্ন শরয়ী বিধি বিধান, বিভিন্ন ধর্ম ইত্যাদি বিষয়েও মত বিনিময় করতেন। তাঁদের সেইসব চিন্তাধারা,মতামত,বক্তব্য ও দৃষ্টিভঙ্গি বিভিন্ন বই-পুস্তকে মুদ্রিত হয়ে বর্তমান প্রজন্মের হাতে পৌছেঁছে। দার্শনিকদের এই দলটির অধিকাংশই ছিলেন ইরানী।এই মহান ব্যক্তিত্বদের মধ্যে কয়েকজন হলেন যায়েদ ইবনে রেফায়া, ইবনে রভান্দি এবং আবু হাইয়্যান তৌহিদি। এদেঁর প্রত্যেকেই নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করে বহু গ্রন্থ লিখে গেছেন।

‘রেসালেয়ে এখওয়ানুস সাফা' নামক সংকলনটিতে একান্নটি প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে। এই গোষ্ঠির গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনার মধ্যে এটি অন্তর্ভুক্ত। সংকলনটির পঞ্চাশটি প্রবন্ধের প্রত্যেকটিই প্রকৃতি বিজ্ঞান, গণিত, ঐশী বা দ্বীনী জ্ঞান, সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে লিখিত হয়েছে।একান্নতম প্রবন্ধটি লেখা হয়েছে এখওয়ানুস সাফা সংস্থাটির গুণগত মান এবং এই সংস্থায় প্রবেশ করার শর্তাবলি সম্পর্কে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে উনবিংশ শতাব্দিতে পশ্চিমা মনীষীরা প্রথমবারের মতো এখওয়ানুস সাফার সংকলনটির সাথে পরিচিত হয় এবং এ সম্পর্কে ব্যাপকভাবে আগ্রহী হয়ে ওঠে এবং এ নিয়ে লেখাপড়া শুরু করে। জার্মানির বিখ্যাত মনীষী ফ্রেডরিক ডিয়েট্রিসি ত্রিশ বছরের মতো এখওয়ানুস সাফা বিষয়ের ওপর পড়ালেখা করেন।বর্তমানে এখওয়ানুস সাফা সংকলনগুলো স্পেনিশ, জার্মান, ইতালিয়, ইংরেজি প্রভৃতি ভাষায় অনূদিত ও প্রচারিত হয়েছে।

হিজরী পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতকের দিকে সেলজুকি শাসনামলে বহু জ্ঞানী-গুণী মনীষীর আবির্ভাব ঘটেছিল। যার ফলে এই সময়কালটা ছিল ফিকাহ বা ইসলামী আইন শাস্ত্র, অলংকার শাস্ত্র এবং হাদিস শাস্ত্র বিষয়ক লেখালেখির যুগ।‘আবু হামেদ মুহাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ গাযযালি তুসি' ছিলেন পঞ্চম শতাব্দির দ্বিতীয়ার্ধের একজন নামকরা দার্শনিক।পাঠদান করা,বিভিন্ন সভা সমাবেশে বক্তৃতা দেওয়া এবং ধর্মীয় আলোচনা অনুষ্ঠান তথা ওয়াজ নসীহত করার মতো বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতার সাথে তিনি জড়িয়ে পড়েন। গাযযালি ধর্মীয় ও সাহিত্যের পাঠ নিয়েছিলেন আবু নাসর ইসমাইলি'র কাছে। তখনো তাঁর বয়স ত্রিশে পৌছেঁ নি অথচ সাহিত্য, ফিকাহ, নীতিশাস্ত্র, ইসলামী বিধি-বিধান, অলংকার শাস্ত্র এবং দর্শনের মতো সূক্ষ্ম বিষয়গুলো ভালোভাবে আয়ত্ত করে ফেলেন। গাযযালি বহু বই লিখেছেন। তাঁর লেখা বইগুলোর মধ্যে ‘এহইয়ায়ে উলুমুদ্দিন' নামকরা। ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয়,নীতিনৈতিকতা,দর্শন ও বক্তৃতা ইত্যাদি স্থান পেয়েছে বইটিতে।

গাযযালির আরেকটি বইয়ের নাম হলো ‘মাকাসিদুল ফালাসিফা'।দর্শন বিষয়ক এই বইটি খুবই সহজ সাবলিল ভাষা ও ভাবে লেখা হয়েছে যাতে বক্তব্যগুলো বা দার্শনিক চিন্তাদর্শগুলো সহজেই বোঝা যায়। এছাড়াও ‘তোহফাতুল ফালাসিফা' নামক আরেকটি গ্রন্থে গাযযালি চেষ্টা করেছেন বিভিন্ন যুক্তি প্রমাণ দিয়ে কোনো কোনো দার্শনিক মতবাদের ভ্রান্তিগুলোকে তুলে ধরতে। সেইসাথে বহু দার্শনিকের মতামতের বৈপরীত্যগুলোর প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন এই বইতে। এই বইটি ইসলামী সভ্যতার ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে।

এবারে আরেকজন মনীষীর সাথে পরিচিত হওয়া যাক। ইনি হলেন ‘গিয়াস উদ্দিন আবুল ফাতহ ওমর বিন ইব্রাহিম'।খৈয়্যাম নামেই তিনি বেশি পরিচিত।হিজরী পঞ্চম শতাব্দির মাঝামাঝিতে ইরানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় নিশাবুরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জীবনকালটা ছিল ঘটনাবহুল। একদিকে সেলজুকিরা ক্ষমতায় আসীন হয় এবং তার কিছু সময় পরই বাগদাদ দখল করে। অন্যদিকে ক্রুসেডের যুদ্ধ শুরু হয় এবং ইসমাইলিয়া ফের্কার আবির্ভাব ঘটে।

খৈয়্যাম গ্রিক জ্ঞান অর্জনের জন্যে ব্যাপক চেষ্টা চালান।তিনি ছিলেন আবু আলি সিনার ছাত্র।অনদিকে তাঁর চিন্তা-চেতনা,তাঁর বর্ণনা কৌশল,তাঁর যুক্তি প্রমাণ পেশ করার স্টাইল সবই ছিল এখওয়ানুস সাফার মতো।খৈয়্যামের রুবাইয়াত বা চতুষ্পদী কবিতাগুলো ভূবন বিখ্যাত।ঐ চতুষ্পদীগুলোতে তাঁর চিন্তাধারা,তাঁর বিশ্বাস, তাঁর ব্যক্তিগত জীবনদর্শন সবই বিধৃত হয়েছে। অনেকক বিশেষজ্ঞ মনে করেন খৈয়্যামের নামে প্রচলিত কবিতাগুলোর অধিকাংশই তাঁর এমন চেহারা ফুটিয়ে তুলেছে যেন তিনি একজন সন্দেহবাদী,দায়িত্বহীন ও নৈরাশ্যবাদী ব্যক্তিত ছিলেন যা তাঁর প্রকৃত চরিত্রের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। অধ্যাপক শহীদ মোতাহহারী ইতিহাসের কাল পরিক্রমা পর্যালোচনা করে অনেক গবেষকের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে লিখেছেনঃ কেউ কেউ ঐতিহাসিক দলিল প্রমাণের ভিত্তিতে বিশ্বাস করেন খৈয়্যাম নামের দু'ব্যক্তি ছিলেন। একজন ছিলেন কবি এবং অপরজন ছিলেন গণিতজ্ঞ ও দার্শনিক। এজন্যে ওমর খৈয়্যামের প্রকৃত দর্শন জানতে হলে তাঁর হাতে লেখা স্ক্রিপ্টগুলো এবং তাঁর দর্শন বিষয়ক গ্রন্থগুলো দেখা উচিত, খৈয়্যামের দর্শন ইবনে সিনার মতো। কিন্তু কাব্যগ্রন্থে তা লক্ষ্য করা যায় না।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/আবু সাঈদ/৫