এপ্রিল ০৩, ২০১৮ ১৬:১৬ Asia/Dhaka
  • মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি- ৬২:  ইরানি মিউজিক বিশেষজ্ঞ

আপনাদের নিশ্চয়ই মনে পড়বে গেল আসরে আমরা মুসলমানদের মাঝে চলমান তাজিয়া, পার্দেখনির মতো পারফর্মিং আর্টস নিয়ে কথা বলেছিলাম। বলেছিলাম ইসলাম বিস্তারের পর আহলে বাইত (আ) এবং মাজহাবি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এই শিল্পগুলোর চর্চা হতো। আমরা কোরআন তিলাওয়াত এবং মিউজিকের মতো শিল্পগুলো যে মুসলমানদের মাঝে চর্চা হতো সে বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত দেওয়ার চেষ্টা করছি।

অনুবাদের চর্চা যে সময়টায় ব্যাপকভাবে হয়েছিল-বিশেষ করে আব্বাসীয় শাসনামলে-সে সময় মিউজিক সম্পর্কিত প্রচুর বই অনূদিত হয়েছিল। ইরানে তো বটেই ভারত এবং গ্রিসেও প্রচুর বই অনূদিত হয়েছিল মিউজিক বিষয়ক। আব্বাসী খলিফাগণও মিউজিক শিল্প এবং এই বিদ্যা চর্চার ওপর ব্যাপক গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে তাঁরা ব্যাপকভাবে সহযোগিতা নিয়েছিলেন সেইসব শিল্পী-সাহিত্যিক ও  মনীষীর কাছ থেকে যারা  মিউজিক এবং এই শাস্ত্রের বিদ্যার ওপর গভীর জ্ঞান রাখতেন। দেখা গেছে এই বিদ্যার ক্ষেত্রে যারাই সহযোগিতা করেছেন তাদের মাঝে ইরানী মনীষীদের সংখ্যা চোখে পড়ার মতো। শাসানীয় আমলে প্রচলিত ভাষাগুলোর সাথে ইরানীদের ভালো পরিচয় ছিল। সে কারণেই তারা শাসানীয় শাসনামলের মিউজিক বিষয়ক বই পুস্তকগুলো আরবি ভাষায় অনুবাদ করতে পেরেছিলেন। তাঁরা নিজেরাও অনেক বই লিখেছিলেন মিউজিক বিদ্যা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে। মিউজিকের সুরগুলোকে পূর্ণতা দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের নতুন নতুন আবিষ্কার এবং লেখালেখিগুলো এই বিদ্যা চর্চার উন্নয়ন ও বিকাশের ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল। অনেক মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ বই তাঁরা উপহার দিয়েছিলেন সঙ্গীত ও মিউজিক চর্চাকারীদের জন্যে।

আব্বাসীয় আমলের মিউজিকের নামকরা ওস্তাদদের মাঝে যিনি সর্বজনবিদিত এবং বিখ্যাত ছিলেন তাঁর নাম হলো ইব্রাহিম মোসেলি। ইব্রাহিমের বাবা ছিলেন ফার্সের অধিবাসী। তিনি ফার্স থেকে কুফায় গিয়েছিলেন। সেই শিশুপাঠের শুরু থেকেই ইব্রাহিম ছিলেন মিউজিকের ব্যাপারে অতি উৎসাহী। মিউজিক ছিল তার ভীষণ পছন্দের ব্যাপার। সেজন্যে তিনি বাবার সাথে কুফায় বেশিদিন থাকলেন না। মিউজিকের টানে তিনি কুফা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন মোসেলে। কিছুদিন তিনি সেখানে কাটান। আর মোসেলে কাটানোর কারণেই তিনি ‘মোসেলি’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। মিউজিক শেখার জন্যে সে সময় রেই শহর ছিল বিখ্যাত। সেজন্যে মোসেলি মোসেলে কিছুদিন কাটানোর পর রেই শহরে চলে যান। রেই শহরে গিয়ে তিনি ইরানী মিউজিক বিশেষজ্ঞ মনীষীগণের কাছে মিউজিকের বিদ্যা আত্মস্থ করেন।

ফার্সি এবং আরবি সুরের পাশাপাশি বীণাবাদ্যের ক্ষেত্রে তাঁর সমকালে ছিলেন অনন্য। ইরাকের মিউজিক অঙ্গনে ইব্রাহিম মোসেলিকে মনে করা হয় আরবি মিউজিকের জনক বা প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে। তিনি আরবি কবিতা বা গানের লিরিকের জন্যে ইরানের মিউজিকের বহু কম্পোজিশন তৈরি করেছিলেন। খলিফাদের দরবার এবং বাগদাদের বেশিরভাগ সঙ্গীতশিল্পী ও মিউজিসিয়ান কিংবা এসহাক মোসেলির মতো মিউজিক বিশারদগণ ইব্রাহিম মোসেলির ছাত্র অথবা কোনো না কোনোভাবে তাঁর কাছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিলেন।

আমরা ইরানী মিউজিক বিশেষজ্ঞ মনীষীদের নিয়ে কথা বলছিলাম। আবু নাস্‌র মুহাম্মদ বিন মুহাম্মদ ফারাবি ছিলেন ইরানের কালজয়ী একজন দার্শনিক ও মনীষী। একদিকে যেমন ছিলেন দর্শন শাস্ত্রের প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব, তেমনি ছিলেন একজন বিখ্যাত গণিতবিদ। এগুলোর পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন মিউজিক বিশেষজ্ঞও। তিনি অসম্ভব মূল্যবান বই লিখে গেছেন মিউজিক বিষয়ে। তাঁর বিখ্যাত দুটি বইয়ের নাম এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। একটি হলোঃ ‘আল্‌মাদখালু ইলাস সানাআতিল মুযিকি’ অপরটি হলো ‘কালামু ফিল মুযিকি’। তবে মিউজিক বিষয়ক ফারাবি’র সবচেয়ে জরুরি এবং শ্রেষ্ঠতম বই হলো ‘এহসাউল উলুম’ এবং আলমুযিকিল কাবির’। এহসাউল উলুম এমন একটি বই যাতে অল্প কটি অধ্যায় রয়েছে,প্রতিটি অধ্যায়ে মিউজিকের বিভিন্ন বিষয়ে আলাদা আলাদা আলোচনা করা হয়েছে। বইটির তৃতীয় অধ্যায়ে মিউজিক সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে।

ব্রিটিশ মিউজিশিয়ান এবং মধ্যপ্রাচ্যবিদ হেনরি জর্জ ফার্মার মনে করেন ফারাবির এহসাউল উলুম গ্রন্থের ভূমিকাটা যদিও মিউজিক সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের লেখার মতো ততোটা সামগ্রিক নয় তবু অন্তত সে পর্যায়ের। এ কারণে ফারাবিকে মনে করা হয় মধ্যযুগের মিউজিক বিষয়ক গ্রন্থাবলির লেখকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম লেখক। মিউজিক সম্পর্কে প্রাচ্য ভূখণ্ডে যতো বই পুস্তক লেখা হয়েছে, তার মধ্যে ফারাবি’র ‘মুযিকি আল-কাবির’ গ্রন্থের কলেবর সবচেয়ে বড়ো। শব্দ-ধ্বনি, মিউজিক ইত্যাদি সম্পর্কে যেসব ব্যাকরণ রয়েছে মোটামুটি তার সবই আছে এই বইতে। মিউজিকের এই ব্যাকরণ বিষয়ক তাঁর ধারণা বা নির্দেশনাগুলো এতো বেশি বৈজ্ঞানিক যে কোনো মিউজিশিয়ানই তার যথার্থতা অস্বীকার করতে পারেন নি।

ইরানের মুসলমান মিউজিকবিদদের মধ্যে অপর একজন মনীষী হলেন আবু আলি সীনা। মেডিকেল সায়েন্সের ক্ষেত্রে কালজয়ী মহান অবদান রাখার পাশাপাশি তিনি মিউজিক, দর্শন, যুক্তিবিদ্যাসহ আরো বিভিন্ন ক্ষেত্রেও রেখে গেছেন মহামূল্যবান এবং অনন্য সব অবদান। তিনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘শেফা’-তে শুধুমাত্র মিউজিক বিষয়ে আলোচনা করার জন্যে কয়েকটি অধ্যায় রেখেছেন। সেসব অধ্যায়ে তিনি মিউজিকের কলাকৌশলের পাশাপাশি শাসানীয় আমলের কিছু মিউজিক নিয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। সাসানীয় আমলে এগুলোকে ‘দাস্তনত্’ বলা হতো। ইবনে সিনা’ই বোধ হয় সর্বপ্রথম কোনো ব্যক্তিত্ব ইসলাম পরবর্তীকালে মিউজিক সম্পর্কে ফার্সি ভাষায় যার লেখা বই এখনো অবশিষ্ট আছে। ইবনে সিনার লেখা মিউজিক সংক্রান্ত অপর একটি বই হলো ‘আন্‌নেজাহ’। এ বইটি তাঁরই ছাত্র বা শিষ্য ‘জুয্‌জানি’ অনুবাদ করেছেন এবং আলায়ি বিশ্বকোষ নাম দিয়েছেন। ব্রিটিশ মনীষী ‘ফার্মার’ও ইবনে সিনার ভূয়সি প্রশংসা করেছেন।

মিউজিকের ক্ষেত্রে ইরানী মনীষীদের মধ্যে অপর একজন নক্ষত্র হলেন সাফিউদ্দিন আব্দুল মোমেন উরমাভি। তিনি ছিলেন সপ্ত শতকের মিউজিক বিশেষজ্ঞ। তিনি যে কতো বড়ো মাপের একজন বিশেষজ্ঞ ছিলেন তা পরিষ্কার বোঝা যাবে যদি তাঁর ‘আল-আদবার’ এবং রেসালাতুশ শারফিয়া’ গ্রন্থ দুটি পড়ার সুযোগ হয়। ফারাবির পর তিনিই সম্ভবত মিউজিক বিদ্যার ওপর পড়ালেখা এবং গবেষণা করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রাচীন ব্যক্তিত্ব। তাঁর পরবর্তীকালে মিউজিক নিয়ে যারা গবেষণা করেছেন তাদের ওপর উরমাভি’র প্রভাব সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়। নবশ শতাব্দী পর্যন্ত তুরস্কসহ আরব দেশগুলোর ওপর ইরানী মিউজিকের ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল। নবম শতাব্দীর পর ইরানে মিউজিক বিষয়ে সেরকম কালজয়ী কোনো সুপণ্ডিতের দেখা মেলে নি।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবু সাঈদ/ ৩