মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি- ৭০: ইরানে শিয়া মাজহাবকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দান
সাফাভি রাজবংশ খ্রিষ্টিয় ১৫০১ সাল থেকে দুই শ’রও বেশি বছর পর্যন্ত ইরানে তাদের শাসনকাজ চালিয়েছে। সাফাভিদের আমলেই ইরানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো শিয়া মাজহাবের শিক্ষাদর্শের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ কিছু রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা সুপ্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
ইসলামী যুগের ইরানের ইতিহাসে দীর্ঘস্থায়ী কিছু ব্যবস্থার গোড়াপত্তন এভাবেই হয়েছে। ইরানে বিদেশীদের শাসনের আট শ’ বছর পর সাফাভিরা পুনরায় ইরানের নিজস্ব ঐতিহ্য ও পরিচয়কে পুনরায় জাগিয়ে তোলেন। তারা এমন একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করেন যে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক বিশেষ সীমান্তের অবশেষ আজো কমবেশি দেখতে পাওয়া যায়।
শিয়া মাজহাবকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দান করা, শিল্প ও কৃষিখাতে উন্নয়ন ঘটানো, বাণিজ্যিক উন্নয়ন ও বিস্তার, সুশৃঙ্ক্ষল একটি সেনাবাহিনী গঠন করা, প্রশংসনীয় ও সম্মানজনক একটি পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করা ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই সাফাভি শাসনামলের বিশেষ অবদানের বিষয়টি ইতিহাসে স্বীকৃত। এ কারণে ইরানের ইতিহাসের এই পর্বটিই বিশ্লেষক, গবেষক এবং বিশেষ করে পশ্চিমা ইরান বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে সবচেয়ে বেশি। সাফাভি শাসনামলে বিশেষ করে শাহ ইসমাইল, শাহ তাহমাসব এবং শাহ আব্বাস প্রথমের সময় ইরানের ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির উন্নয়ন ও বিকাশ ছিল চোখে পড়ার মতো। ইসলামের উন্নয়ন ও বিকাশে সাফাভি শাসকদের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো শিয়া মাজহাবকে ইরানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় স্থাপন করা। তাঁরা সমাজে শিয়া মাজহাবের বিস্তারে যেসব পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন সেগুলোর মধ্যে ছিল এই মাজহাবের হুকুম আহকাম বা বিধি-নিষেধগুলোকে চালু করার জন্যে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং শিয়া মাজহাবের আলোকেই সমাজকে ঢেলে সাজানোর ব্যবস্থা করা।
তারা এই কাজ করার জন্যে লেবানন এবং বাহরাইনের শিয়া আলেমদের সহযোগিতা কামনা করেন এবং এ লক্ষ্যে তাঁদেরকে ইরানে আসার আমন্ত্রণ দেন। শাহ ইসমাইলের আমলে গারাকি’র মতো বিশিষ্ট আলেম ও চিন্তাবিদ ইরানে এসেছিলেন এবং সাফাভি যুগের সামাজিক নীতি, ধর্ম ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতির ওপর প্রভাবশালী ভূমিকা রাখেন। লেবাননের আলেমগণ তাদের জ্ঞান ও চিন্তাদর্শের আলোকে ইরানের ফকিহদের একটি প্রজন্মকে প্রশিক্ষিত করেন। পরবর্তী পর্যায়ে এই ফকিহগণই সাফাভি সরকারের নীতি নির্ধারণী ভূমিকা পালনের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ইরানে শিয়া মাজহাবকে রাষ্ট্রীয় মাজহাবের মর্যাদা দানের মাধ্যমে সাফাভিরা শিয়াদের মনে নতুন প্রাণের সঞ্চার করেন। ইসলামের ইতিহাসে কোনো দেশে রাষ্ট্রীয় মাজহাবের স্বীকৃতি প্রদানের ঘটনা এটাই প্রথম। এই ঘটনায় সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন আলেম ওলামা এবং আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বগণ। তারা ধীরে ধীরে ইরানে আসতে শুরু করেন। তাঁদেরকে ইরানের ভাষা শেখানোর উদ্দেশ্যে তখন বিভিন্ন এলাকায় ফার্সি ভাষা শেখার ক্লাসের আয়োজন করা হয়েছিল।
বিশেষ করে যেসব এলাকায় অতিথি সমাগম বেশি ছিল সেসব এলাকাতেই এরকম ভাষা শেখার ক্লাসের আয়োজন করা হয়েছিল। এসব ক্লাসে ভাষা বলতে, পড়তে এবং লিখতেও শেখানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বলাবাহুল্য কোনো কোনো অভিবাসী ফার্সি ভাষা এতোটাই ভালোভাবে আয়ত্ত করেছিলেন যে তাঁরা এ ভাষায় বহু মূল্যবান অনেক লেখালেখিও করে গেছেন। গদ্য এবং পদ্যে তাঁদের সেসব লেখালেখি এখন ইরানী সাহিত্যের এক সমৃদ্ধ অধ্যায় হয়ে আছে। শেখ বাহায়ি সেইসব লেখকদেরই একজন।
সাফাভিদের আমলে সাহিত্য, চিকিৎসাবিদ্যা, ঔষধতৈরি ইত্যাদির মতো বিভিন্ন বিষয়ের চর্চার পাশাপাশি বিচিত্র শিল্প এবং সামরিক অস্ত্রশস্ত্র তৈরির ক্ষেত্রে যেমন উন্নয়ন ঘটেছিল তেমনি প্রশাসনিক কাঠামোর ক্ষেত্রেও ঘটেছিল ব্যাপক উন্নয়ন। শাহ তাহমসেবের সময়ে কবিতা ও সাহিত্যকর্মে রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় প্রভাব পড়েছে। শোকগাথা এবং শোকগীতি ধরনের সাঙ্গীতিক চর্চার একটা ধারা গড়ে উঠেছিল এ সময়। তবে শোকগীতি কবিতার মূল বিষয় ছিল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নবীজির পবিত্র আহলে বাইতের মহান সদস্যদের কীর্তির প্রশংসা কেন্দ্রিক। উদাহরণ স্বরূপ মুহতাশিম কাশানি’র কসিদার কথা উল্লেখ করা যায়। তিনি যেসব শোক গীতি লিখেছেন সেগুলো ছিল কারবালার ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডিকে নিয়ে। সে সময় আসলে সকল কবিই কারবালার ঘটনাকে নিয়েই শোকগাথা রচনা করেছেন। কারবালায় নবীজির আহলে বাইতের মহান সদস্য হযরত ইমাম হোসাইন (আ)সহ যাঁরা নির্মমভাবে শাহাদাতবরণ করেছিলেন, তাদের সেইসব ট্র্যাজিক বর্ণনাই ছিল শোকগাথার মূল উপজীব্য।
সাফাভি বাদশারা শিয়া মাজহাবের বিস্তার ঘটানোর জন্যে শিয়া আলেম ওলামাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টায় যতোটা গুরুত্ব দিয়েছিলেন, ততোটাই গুরুত্ব দিয়ে তাঁরা ধর্মীয় বা মাজহাবি শিক্ষাদীক্ষা প্রসারের আয়োজন করতে গড়ে তুলেছিলেন অসংখ্য ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ইরানে যেসব শিয়া আলেম ওলামা এসেছিলেন তাঁরা শিরায, তাব্রিয, কাযভিন, মাশহাদ, কোম এবং ইস্ফাহানে বসবাস করতেন এবং সাফাভি শাসকগণ এইসব শহরে অসংখ্য মসজিদ মাদ্রাসা স্থাপন করেছিলেন। ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আলেমদের কর্মতৎপরতার সুবাদে শিয়া মাজহাবের শিক্ষাদীক্ষাগুলোর বিস্তার ঘটতে শুরু করে। এই কালপর্বে তাফসিরে কোরআন, হাদিস শাস্ত্র, ফিকাহ, উসূলে ফিকাহ, এলমে কালামের মতো ইসলামী জ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ শাখাগুলোর চর্চা ব্যাপকভাবে চলতে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই এসব বিষয়ে বড়ো বড়ো বিদ্যান যেমন গড়ে ওঠে তেমনি অনেক মূল্যবান বইপুস্তকও রচিত হয়। সাফাভি আমলেই মির্দামাদ, মোল্লা সাদরা শিরাযি এবং তাঁদের ছাত্রদের দর্শন চর্চার ধারা ব্যাপকতা লাভ করেছিল। চিকিৎসাবিদ্যাও ব্যাপকভাবে চর্চা হয়েছিল এ সময়। অপারেশান করা বা ঔষধ বিজ্ঞান নিয়েও চর্চা হয়েছিল।
সাফাভি শাসনামলে স্থাপত্যশিল্পের ক্ষেত্রেও ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছিল। উন্নয়নের মাত্রাটি পরিমাপ করা যাবে একটিমাত্র প্রবাদ থেকে। ‘ইস্ফাহান নেসফে জাহান’-অর্থাৎ ইস্ফাহান হচ্ছে বিশ্বের অর্ধেক। তার মানে ইস্ফাহান দেখা হলে বিশ্বের অর্ধেক দেখা হয়ে যাবে। সারা বিশ্বে দেখার মতো যা কিছু আছে তার অর্ধেকই ইস্ফাহানে রয়েছে-এইরকম প্রবাদ থেকেই অনুমান করা যায় সাফাভি আমলে কতোটা উন্নতি ঘটেছিল ইস্ফাহানের।#
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবু সাঈদ/ ২৫