দেখব ঘুরে ইরান এবার: বেহশাহর ছিল ইরানের দ্বিতীয় রাজধানী
বেহশাহরের উত্তর দিকে রয়েছে কাস্পিয়ান সাগর এবং গোরগান উপসাগর। পশ্চিম দিকে রয়েছে ‘সারি’ উপশহর।
বেহশাহরের দক্ষিণ দিকে রয়েছে ঐতিহাসিক সেমনান প্রদেশ আর পূর্বদিকে রয়েছে গোরগান প্রদেশ। বেহশাহর উপশহরটি আলবোর্য পর্বতমালার উত্তরাঞ্চলীয় উপত্যকায় অবস্থিত। শহরটি ক্রমশ বিস্তৃতি লাভ করেছে কাস্পিয়ান সাগরের দিকে। স্বাভাবিকভাবেই এখানকার আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ এবং আর্দ্র। বেহশাহর উপশহরের জনগণের অর্থনৈতিক ভিত্তি কৃষিকাজ, বাগানের কাজ এবং বিভিন্ন ধরনের শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। এখানে যেসব শস্যপণ্য উৎপন্ন হয়, সেগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি হলো গম, চাল, তামাক এবং কমলা জাতীয় বিচিত্র ফল।
বেহশাহরের একদিকে পাহাড়, পর্বত এবং সবুজ বনবনানীপূর্ণ টীলাময় সৌন্দর্য আর অপরদিকে বিস্তীর্ণ সমুদ্রের স্বচ্ছতোয়া পানির হৃদয় নিংড়ানো হাতছানি। সব মিলিয়ে সৌন্দর্য আর ভালো লাগার পরিচ্ছন্ন এক অনভূতি। বলা হয়ে থাকে ইতিহাসের বিভিন্ন যুগপর্বে এই শহরটি বিভিন্ন নামে পরিচিতি পেয়েছিল। কেউ কেউ বলতো ‘কাবুদ জমে’। আবার অনেকেই একে ডাকতো ‘পাঞ্জে হেজর’ বলে। কেউবা আবার ‘কালবদ’ নামেই চিনতো। ‘খারগুরন” নামেও পরিচিতি ছিল বেহশাহরের-এরকম তথ্যও ইতিহাসে মেলে।

যে নামেই লোকেরা চিনুকনা কেন, বেহশাহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর বৈশিষ্ট্যে কোনো হেরফের নেই। ইতিহাসের বর্ণনা অনুযায়ী সাফাভি রাজবংশের সর্বপ্রথম বাদশা শাহ আব্বাস সাফাভির আদেশে ১৬১২ খ্রিষ্টাব্দে এই শহরটির গোড়াপত্তন করা হয়। সে সময় নতুন এই শহরটিকে ‘আশরাফুল বালাদ’ অর্থাৎ সর্বশ্রেষ্ঠ শহর বলে অভিহিত করা হতো। শহরটিতে তখন সর্বপ্রথম শাহ আব্বাসের বাসস্থান ছিল। সমগ্র মযান্দারনে এটাই ছিল সাফাভিদের সর্বপ্রথম প্রাসাদ। সাফাভি ইতিহাসবিদ ‘এসকান্দার বেগ মুন্সি’ এই শহর নির্মাণ প্রসঙ্গে বলেছেনঃ
এখানকার প্রাসাদ, বাগবাগিচা, বিশাল বিশাল ভবন, হাম্মাম, অডিটোরিয়ামসহ বড়ো বড়ো বাড়িঘর সে সময়কার নিপুণ এবং সুদক্ষ শিল্পীদের হাতেই গড়ে উঠেছিল এবং তারাই শহরটির নাম দিয়েছিল ‘আশরাফ’। বিভিন্ন সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে জানা যায় সাফাভিদের এবং শাহ আব্বাসের শাসনামলে বেহশাহর অসম্ভব উন্নত ও খ্যাতিমান ছিল। প্রকৃতপক্ষে তখন বেহশাহর ছিল দেশের দ্বিতীয় রাজধানী। সাফাভি বাদশারা বছরের বেশ কয়েক মাস এই বেহশাহরে কাটাতেন।
বেহশাহরের বিভিন্ন প্রান্তে ঐতিহাসিক বহু নিদর্শন লক্ষ্য করা যায়। আর এ থেকেই প্রমাণিত হয় যে সাফাভি যুগে এই শহরটি কতোটা জাঁকজমকপূর্ণ ছিল। এখানে বেশ কিছু প্রাকৃতিক নিদর্শনও রয়েছে। রয়েছে ‘হুতু’ এবং ‘কামারবান্দ’ নামের দুটি বিখ্যাত গুহা। এইসব গুহায় যেসব জিনিসপত্র পাওয়া গেছে, সেসব থেকে প্রমাণিত হয় মযান্দারনের এই এলাকাটিতেই আঞ্চলিক সর্বপ্রথম মানব বসতি গড়ে উঠেছিল। তবে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে এই শহরটির উপর দিয়েও বয়ে গেছে অনেক চড়াই উৎরাই, অনেক ঘটনা দুর্ঘটনা। অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ সংঘাতে এমন তুর্কেমেনীয় হামলায় যেমন শহরটি ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছিল, তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ইরানের ওপর আফগানদের শাসনামলেও।
তবে মুহাম্মাদ হাসান খান কাজার বেহশাহরের প্রতি ভীষণভাবে আকৃষ্ট ছিলেন বলে এই শহরে প্রায়ই কাটাতেন তিনি। কাজার রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা অগা’ মুহাম্মাদ খানও চেষ্টা করেছেন এই শহরটিকে নতুন করে সাজাতে। তাঁর আমলেই বেহশাহর পুনরায় তার হারানো ঐতিহ্য ও ঐশ্বর্য ফিরে পায়। যাই হোক বেহশাহরের ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয় যেসব স্থাপনা ও নিদর্শন সেগুলো আজো আকৃষ্ট করে যাচ্ছে দেশী বিদেশী পর্যটকদের।

এখানকার গুরুত্বপূর্ণ যেসব প্রাচীন এবং ঐতিহাসিক নির্দশন রয়েছে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সাফিআবাদ প্রাসাদ, চেহেল সুতুন ইমারত ও বাগিচা, ইমারত ঝর্ণাধারা এবং আব্বাস আবাদ পুকুর। আর প্রাকৃতিক নিদর্শনের মধ্যে উল্লেখ করা যায় মিয়নকলেহ উপদ্বীপ এবং অসংখ্য গূহার কথা। এইসব নিদর্শনের সাথে আমরা বরং খানিকটা পরিচিত হবার চেষ্টা করি। শুরুতেই আব্বাস আবাদ পুকুরের সাথে পরিচিত হওয়া যাক।
বেহশাহর মূল শহর থেকে ৯ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্বে আলবোর্য পর্বতে এই পুকুরটি অবস্থিত। পর্বতের কারণে স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা উঁচুতে। তাছাড়া চারদিকে রয়েছে সবুজ জঙ্গল আর গাছ গাছালি। এর মাঝে সাফাভি আমলে গড়ে উঠেছিল বাঁধ, পুকুর এবং পুকুরের পাশে একটি প্রাসাদ। মোটামুটি দশ হেক্টর ভূমি জুড়ে নির্মাণ করা হয়েছে প্রাসাদটি। আজকাল সুইমিংপুল বলতে যা বোঝায়, এখানকার পুকুরগুলো ছিল ঠিক তাই। পুকুরের মাঝখানে ছোট্ট একটি স্থাপনা ছিল। যখন পানি টৈটুম্বুর হয়ে যেত পুকুর, তখন ডুবে যেত স্থাপনাটি। কেবল প্রান্তগুলো দ্বীপের মতো ভেসে থাকতো।

পুকুরের চারপাশ ঘিরে ছিল কয়েকটি টাওয়ার। নিরাপত্তা টাওয়ার ছিল এগুলো। ছিল গোসলখানা এবং পাথুরে পথ। আব্বাস আবাদ নামে যে বাঁধের কথা বলেছিলাম ঐ বাঁধটি দেওয়া হয়েছে নীচু এলাকার গ্রামগুলোতে কৃষিকাজের জন্যে পানি সরবরাহ করতে। ১৬১২ খ্রিষ্টাব্দে এখানে গড়ে তোলা হয়েছে প্রমোদ উদ্যান। শাহ আব্বাসের আদেশেই এই বিনোদন কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হয়েছে বলে ইতিহাসে পাওয়া যায়। এখানে যেসব নিরাপত্তা টাওয়ার অর্থাৎ পর্যবেক্ষণ টাওয়ার তৈরি করা হয়েছিল সেগুলোকে এখন আর সেভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে না। ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়েই তারা নিজেদের অস্তিত্ব কোনোরকমে টিকিয়ে রেখেছে।
এবারে সাফি আবাদ প্রাসাদের প্রসঙ্গে আসা যাক। বেহশাহরের আরেকটি ঐতিহাসিক নিদর্শন এটি। মূল শহর থেকে এক কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে একটি টিলার ওপরে এই প্রাসাদটি নির্মাণ করা হয়েছে। বন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে সর্পিল আঁকাবাঁকা পাথুরে পথ পেরিয়ে এই প্রাসাদে যেতে হতো। জঙ্গলের পর জঙ্গলে এলাকাটি ঢাকা। একপাশে সমুদ্র, তারপাশে সবুজ বনানী-ভাবতেই সৌন্দর্যের চিত্র ভেসে উঠবে মনের পর্দায়। এই প্রাসাদের ওপরও বহুবার হামলা হয়েছে। বহুবার মেরামতও করা হয়েছে। আফগানীদের হামলায়ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রাসাদটি। প্রাসাদের বিরাট একটা অংশ আগুনে পুড়ে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে বিশেষ করে নাদের শাহ এবং নাসের উদ্দিন শাহ কাজারের সময় প্রাসাদটিকে পুনর্নির্মাণ করা হয়। বলা হয়ে থাকে স্বৈরাচারী শাহের আমলে এই প্রাসাদটিকে মার্কিনীরা তাদের আড়িপাতার কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করতো। অবশ্য ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের পর এইসব আখড়া ভেঙে যায়। #
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/০১