আগস্ট ০৫, ২০১৮ ১৯:৫৪ Asia/Dhaka
  • দেখব ঘুরে ইরান এবার: ইরানের নুশাহরের সমুদ্র সৈকত

নুশাহরের উত্তরদিকে রয়েছে কাস্পিয়ান সাগর। দক্ষিণ এবং দক্ষিণ পশ্চিমে রয়েছে আলবোর্য পর্বতমালার পশ্চিমাঞ্চলীয় এবং কেন্দ্রীয় পর্বতগুচ্ছ। নুশাহরের পূর্বদিকে রয়েছে নূর উপশহর আর পশ্চিম দিকে রয়েছে চালুস উপশহর।

এই উপশহরের আবহাওয়া দুই ধরনের। পার্বত্য এলাকার আবহাওয়াটা ঠাণ্ডা এবং শুষ্ক বিশেষ করে দীর্ঘ শীতকালে এই আবহাওয়া বিরাজ করে এখানে। আরেক ধরনের আবহাওয়া হলো নাতিশীতোষ্ণ এবং আর্দ্র।

নুশাহর আসলে একটা বন্দর নগরী। এই মফস্বল শহরটির কেন্দ্রীয় শহরের নামটিও নুশাহর। এই শহরটি বেশ সুন্দর এবং আকর্ষণীয়। মযান্দারন প্রদেশের পর্যটক আকর্ষণীয় এলাকাগুলোর অন্যতম এই নুশাহর। একদিকে সবুজ বন বনানী, অপরদিকে নাতিশীত্ষ্ণে আবহাওয়া, তদুপরি অপেক্ষাকৃত কম লবণাক্ত পানিময় অগভীর সৈকতে সাঁতার কাটার সুবিধা, সহনীয় উষ্ণতা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য নুশাহরের প্রতি ভ্রমণ পিপাসুদের আকর্ষণের মূল কারণ। এই এলাকাটি ভ্রমণ করার জন্যে তো বটেই অবকাশ যাপন বা বিশ্রাম করার জন্যেও খুবই উপযোগী একটি এলাকা। নুশাহরে দেখার মতো আরো দুটি পার্ক আছে। গাছ-গাছালিতে পরিপূর্ণ এই পার্কগুলোর একটি হলো ‘ভারকভিচ পার্ক’ এবং অপরটি ‘সি সাঙ্গন’ পার্ক।

জঙ্গলাকীর্ণ পার্ক ‘সি-সাঙ্গন’ নু-শাহর থেকে পঁচিশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সমুদ্র সৈকতে গড়ে ওঠা সবুজ শ্যামল এই বনানী কী যে দারুন প্রাকৃতিক শোভা বর্ধন করেছে তা বর্ণনা করে বোঝানো মুশকিল। এখানে রয়েছে বিনোদনের সকল সুযোগ সুবিধা। রয়েছে প্রকৃতিপ্রেমীদের ভালো লাগার সকল আয়োজন। এ কারণেই দেশী বিদেশী ভ্রমণকারীদের পদচারণায় এ এলাকা প্রায় সারা বছর ধরেই মুখর থাকে। বলা হয়ে থাকে সি সাঙ্গন পার্কে কিছু দুর্লভ এবং ব্যতিক্রমধর্মী গাছপালা থাকার কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এই পার্কটির ব্যাপক খ্যাতি আছে।

নু-শাহরের প্রাচীন একটা নাম ছিল। নামটি হলো ‘খচাক’। এই নামটিও কালক্রমে পাল্টে গিয়ে নতুন নামে পরিচিত হয়েছে শহরটি। নতুন নামে শহরটিকে ডাকা হতো ‘হাবিব আবাদ’। ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই বন্দর নগরীতে ব্যাপক উন্নয়ন কাজ করা হয়েছে। বহু প্রয়োজনীয় স্থাপনাও গড়ে তোলা হয়েছে। নুশাহরে কৃষিকাজও হয় ব্যাপক পরিমাণে। এখানে উৎপন্ন কৃষিপণ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ধান এবং অন্যান্য শস্যদানা জাতীয় পণ্যসামগ্রী। বণ থেকেও পাওয়া যায় প্রয়োজনীয় কিছু সামগ্রী যেমন কাঠ এবং কয়লা। হস্তশিল্প সামগ্রীও ব্যাপক রয়েছে এই শহরটিতে। এগুলোর মধ্যে গালিচা, জাজিম এবং মাদুর জাতীয় জিনিসও রয়েছে।

মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সাথে যোগাযোগের একটি ট্রানজিট পয়েন্ট এই নুশাহর। বিশেষ করে সমুদ্রপথে যোগাযোগের জন্যে এইখানকার বন্দরটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। কাস্পিয়ান সাগরের তীরবর্তী আরো যেসব প্রতিবেশী দেশ রয়েছে সেসব দেশের সাথে বাণিজ্যিক যোগাযোগ ব্যাপকভাবে গড়ে উঠেছে নুশাহরের মাধ্যমে। নুশাহর বন্দর থেকে ক্যাভিয়ার, গোশত, মাছ, জুতা, শুকনো ফল, হস্তশিল্প সামগ্রী এবং আরো অনেক শিল্প সামগ্রী মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে রপ্তানী হয়। কেবল মধ্য এশিয়াতেই নয় বরং ইউরোপীয় দেশগুলোতেও এখানকার পণ্য যায়। আবার সেসব দেশের অনেক পণ্যও এই বন্দরের মধ্য দিয়ে ইরানে প্রবেশ করে।

ইরান একটা বিশাল দেশ। এই দেশে তাই যতো বেশি খোঁজা যাবে, অনুসন্ধান করা যাবে ততো বেশি সুন্দর সুন্দর অজানা বস্তুর সাথে পরিচিত হবার সুযোগ মিলবে। এই নুশাহরের কথাই ধরা যাক। এখানে আবিষ্কৃত হয়েছে চমৎকার একটি গ্রাম। এই গ্রামের নাম হলো ‘দেহকাদেহ কান্দেলুস’। আলবোর্য পর্বতমালার পাদদেশজুড়ে বেশ কয়েক হাজার গ্রাম রয়েছে। বরকতপূর্ণ সুন্দর সুন্দর এইসব গ্রামের মধ্যে কান্দেলুসের আলাদা একটা মর্যাদা রয়েছে। নুশাহর থেকে ৭৫ কিলোমিটার দক্ষিণপূর্বে এই গ্রামটি অবস্থিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এই গ্রামটির উচ্চতা ১৬৫০ মিটার।

পার্বত্য উপত্যকার গ্রামগুলোর প্রায় একই বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। গ্রামের অলিগলিগুলো সাপের মতো আঁকাবাঁকা আর ঘরগুলো একটার ছাদের ওপর আরেকটা ঘরের উঠোনের মতো নির্মিত। এই চমৎকার ভবন নির্মাণ কৌশলের আড়ালে গ্রাম অনেকটাই ঢাকা পড়ে যায়। ভেতরের প্যাঁচালো রাস্তাগুলো বেশিরভাগই পাথরের। তবে মাঝে মাঝে প্রাচীন স্টাইলের কিছু দ্বিতল ঘরও দেখতে পাওয়া যায়। এগুলোর ছাদ ঢেউটিনের চালার মতো। দেয়াল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মাটির তৈরি। ছোটো ছোটো ঝুলবারান্দা, সাদামাটা স্টাইলে তৈরি করা কাঠের জানালা ইত্যাদি ঘরগুলোর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করার পাশাপাশি সমগ্র গ্রামটিকেই আকর্ষণীয় করে তুলেছে। তবে নতুন করে যেসব বাড়িঘর নির্মাণ করা হচ্ছে সেগুলোতে চক, সিমেন্টের কাজ, প্লাস্টারিংয়ের কাজের পাশাপাশি ইট এবং ব্লকেরও ব্যবহার করা হচ্ছে।

শীতকালে কান্দেলুস গ্রামের জনসংখ্যা কমে যায় আর গ্রীষ্মকালে বেড়ে যায়। আবহাওয়ার কারণে এমনটি ঘটে। কান্দেলুস গ্রামের লোকজন চাষাবাদ বা কৃষিকাজ করে, পশু পালন করে, বাগবাগিচার কাজ করে। আবার এক শ্রেণীর লোকজন হস্তশিল্প সামগ্রী নির্মাণের কাজের সাথেও জড়িত। এখানে যেসব কৃষিপণ্যের চাষাবাদ বেশি হয় সেগুলোর মধ্যে রয়েছে গম, ধান, যব ইত্যাদি। আর এখানকার বাগানগুলোতে আপেল, আখরোট এবং আপেলের মতো দেখতে আরেক জাতের ফল ব্যাপক পরিমাণে ফলে। এই ফলটিকে ইংরেজিতে পিচ বলা হয়। ঐতিহ্যবাহী পশুপালনের রেওয়াজের পাশাপাশি পাখি পালনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় এখানে।

আবহাওয়াগত উপযোগিতার কারণে এখানে বিচিত্র ফুল যেমন জন্মে তেমনি অনেক ওষুধি উদ্ভিদও জন্মে প্রচুর। বলাবাহুল্য ওষুধি উদ্ভিদ এই গ্রামের লোকজনের আয়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ উৎসে পরিণত হয়েছে। ইতিহাসবিদদের মতে এই গ্রামটি খ্রিষ্টপূর্ব তিন হাজার বছরের পুরোণো। স্বাভাবিকভাবেই বিচিত্র সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রভাব পড়েছে এই গ্রামের ওপর। খ্রিষ্টপূর্বকালের সভ্যতা, ইসলাম-পূর্ব ইরানের সভ্যতা, ইসলাম পরবর্তী ইরানের সভ্যতা ইত্যাদি বিভিন্ন সভ্যতার সাথে পরিচিত হয়েছে গ্রামটি। জরথ্রুস্টদের বহু কবরও এখানে আবিষ্কৃত হয়েছে। আরো আবিষ্কৃত হয়েছে প্রাচীন বহু আসবাবপত্র।

নাসের উদ্দিন শাহ কাজারও এই এলাকা সফরের কথা উল্লেখ করে গিয়েছিলেন। ইরানে নামকরা আর্টিস্ট ও ডিজাইনার কামালুল মুলক ছিলেন নাসের উদ্দিন শাহ কাজারের সফরসঙ্গী। তিনি নিজে এই গ্রামের ওপর একটা পেইন্টিং করেছেন। ‘সাহেবকারা’নিয়ে’ মিউজিয়ামে ঐ পেইন্টিংটি এখনো শোভা পাচ্ছে। মিউজিয়ামে এই গ্রামের প্রাচীন নিদর্শনগুলো প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফলে উৎসুক যে কেউই এগুলো দেখে আসতে পারেন।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/০৫