দেখব ঘুরে ইরান এবার: গোলেস্তান প্রদেশের গোম্বাদে কাবুস শহর
গোম্বাদে কাবুস শহরটির আয়তন পাঁচ হাজার একাত্তর বর্গ কিলোমিটার। গোলেস্তান প্রদেশের পূর্ব ভূখণ্ডে অবস্থিত এই শহরটি। শহরটির উত্তর দিকে রয়েছে তুর্কমেনিস্তান প্রজাতন্ত্র, পশ্চিমে আলি আবাদ এবং অগ্গালো ও গোরগান শহর।
গোম্বাদে কাবুসের পূর্বদিকে রয়েছে কালা’লেহ ও মিনুদাশ্ত্ শহর আর দক্ষিণে দিকে রয়েছে অযদ্ শাহর এবং রমিয়ন শহর। গোম্বাদে কাবুস শহরটি সমতলভূমি এবং পার্বত্য এলাকায় বিভক্ত। কাশলকি চারণভূমিও রয়েছে এখানে তবে একেবারে তুর্কমেনিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকায়। অযদ্শাহর এবং রমিয়ন যেহেতু উঁচুস্থানে অবস্থিত সেজন্যে এখানকার আবহাওয়া পার্বত্য এবং নাতিশীতোষ্ণ।
তবে উত্তরাঞ্চল অর্থাৎ তুর্কমেনিস্তান সীমান্তের দিকে চলে গেছে যে ‘গোরগান রুদ’ নদী ঐ এলাকার আবহাওয়া মরু প্রান্তরীয় অর্ধ-নাতিশীতোষ্ণ এবং অর্ধশুষ্ক। গোম্বাদে কাবুস শহরের জনসংখ্যা বা অধিবাসীদের মধ্যে তুর্কামানি যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে আজারবাইজানি তুর্কি অভিবাসী এবং সেইসাথে রয়েছে খোরাসান, সেমনান, সিস্তান-বেলুচিস্তানসহ আরো বহু এলাকা থেকে আসা বিচিত্র গোত্র ও জনপদের মানুষ। এখানকার লোকজনের প্রধান পেশা হলো কৃষিকাজ,পশুপালন ইত্যাদি। এ এলাকায় উৎপাদিত কৃষিপণ্যের মধ্যে রয়েছে গম, যব, তুলা, তেল উৎপাদিত হয় এমন বহু শস্যদানা ইত্যাদি। গোম্বাদে কাবুস এলাকার তুলা এতোই উন্নতমানের যে বিশ্বব্যাপী তার খ্যাতি রয়েছে।
এখানকার উৎপাদিত পণ্য সামগ্রিকে প্রক্রিয়াজাত করার জন্যেও গড়ে উঠেছে বিচিত্র কল-কারখানা। যেমন আটা ও ময়দার কারখানা, তেলের কারখানা, তুলা রিফাইন মিল, সংরক্ষিত টিনজাত খাদ্য তৈরির কারখানা, খাবার ক্যানে প্রিজার্ভ করার কারখানা ইত্যাদি। এই শহরে বিচিত্র হস্তশিল্প সামগ্রীও উৎপন্ন হয় প্রচুর পরিমাণে। এখানে তৈরি হয় হাতে বোণা উন্নত মানের গালিচা, হাতে বোণা গেলিম, দোতারা, সাজ সজ্জারও বিচিত্র অলংকার, বিভিন্ন রকমের সুঁই সুতার কারুকাজ ইত্যাদি। গোম্বাদে কাবুস এলাকার আরেকটি আকর্ষণীয় দিক হলো এখানে বিভিন্ন রকমের ঘোড়া লালন পালন করার রেওয়াজ রয়েছে। তুর্কামানি ঘোড়া সারা বিশ্বেই বিশেষভাবে খ্যাত।
প্রাচীন জোরজানের ধ্বংসাবশেষের পূর্বদিকে গড়ে উঠেছে গোম্বাদে কাবুস প্রাচীন শহর। বর্তমান যে শহরটি দেখা যায় এটি ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়। হিজরি চতুর্থ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের বিখ্যাত কবি এবং বাদশাহ কাবুস বিন ভুশ্মগির-এর নামের সাথে মিল রেখে এর নামকরণ করা হয়েছে গোম্বাদে কাবুস। এখনো সেই নামেই এই শহরের পরিচিতি রয়েছে। গোম্বাদ ইরানের একেবারে উত্তর সীমান্তে অবস্থিত। ইরানের রাজধানী শহর তেহরান থেকে এই শহরের দূরত্ব ৪৯৩ কিলোমিটার। গোম্বাদ শহরের বেশিরভাগ লোকজনই তুর্কামানি। শহরটি অনেকটা মরুপ্রান্তিয়। এ কারণে এখানকার আবহাওয়া গ্রীষ্মের সময় গরম আর শীতকালে অর্ধ নাতিশীতোষ্ণ। শহরের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪৫ মিটার। গোম্বাদে কাবুস শহরটি বেশ পরিপাটি করে বানানো হয়েছে। পুরোটা শহরই সাজানো গোছানো।

গোম্বাদে কাবুস সেই ইসলাম-পূর্ব যুগ থেকেই একটি পরিকল্পিত সুন্দর শহর ছিল। হিজরি তৃতীয় এবং চতুর্থ শতকে বেশ সমৃদ্ধ এবং গুরুত্বপূর্ণ শহর হিসেবে মর্যাদার অধিকারী ছিল শহরটি। কিন্তু ৬২০ হিজরিতে মোঙ্গলদের ধ্বংসাত্মক আক্রমণে শহরটি পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। যুদ্ধের আগুণ নিভে যাবার পরও শহরটি আর তার হারানো ঐতিহ্য ও জাঁকজমক ফিরে পায় নি। আজকাল অবশ্য কাবুস টাওয়ারটি গোম্বাদে কাবুস শহরের সেই পুরোণো স্মৃতির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এদিক থেকে শহরটির গুরুত্ব এখনো যথেষ্ট। এ শহরের সে সময়কার কিছু কিছু স্থাপনা এতোই চমৎকার এবং আকর্ষণীয় ছিল যে স্বয়ং হামলাকারী মোঙ্গলরা পর্যন্ত সেগুলোর প্রশংসা করতে বাধ্য হয়েছে।
সেই সুবাদে কিছু কিছু স্থাপনা ধ্বংস করা থেকে তারা বিরত ছিল। কাবুস টাওয়ার তারই একটি। এর বাইরেও রয়েছে ইমামযাদা ইয়াহ্ইয়া বিন যায়েদ এবং প্রাচীন জোরজানের ধ্বংসাবশেষ ইত্যাদি। এখানে আরো আছে অসংখ্য পুকুর-অলা’গোল পুকুর, আজিগোল পুকুর, অলমাগোল পুকুর। এসব পুকুরে বাস করে অতিথি পাখির ঝাঁক। এসব পাখির বিচরণে পুরো এলাকারই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ব্যাপক বেড়ে গেছে। গোম্বাদে কাবুস শহরের দেখার মতো আরো রয়েছে সাভরকরি কমপ্লেক্স। এখানে ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। শরৎ ঋতু এবং বসন্ত ঋতুতে সাধারণত এই ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়ে থাকে।
কাবুস টাওয়ারটি গোম্বাদে কাবুস শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে একটি টিলার ওপর নির্মাণ করা হয়েছে। এই টাওয়ারটি ইটের তৈরি পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন টাওয়ার হিসেবে স্বীকৃত। হাজারেরও বেশি বছরের পুরোণো এই টাওয়ারটি কেবল যে ইরানের পুরাতাত্ত্বিক গবেষকদেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তাই নয় বরং পৃথিবীর অন্যান্য দেশের গবেষকদেরও প্রশংসা কুড়িয়েছে। পুরাতত্ত্ব গবেষকগণ এ নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করেছেন এবং করে যাচ্ছেন। আর এই গবেষক আকর্ষণীয় টাওয়ারটি মনোযোগ কেড়েছে পৃথিবী ঘুরে বেড়ায় যেই পর্যটকগণ,তাঁদেরও।
পশ্চিমা ইরানবিদ প্রফেসর আর্থার উপাম পোপ এই স্থাপনাটির ব্যাপারে তাঁর ‘ইরানী স্থাপত্য’ নামক বইতে লিখেছেন: “এশিয়ার বিস্তীর্ণ মরুভূমির বরাবরে এবং আলবোর্য পর্বতমালার পূর্বভাগে ইরানী স্থাপত্য শিল্পের একটি অনন্য সাধারণ নিদর্শন রয়েছে যা ইরানের মর্যাদা ও সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের স্মারক হয়ে আছে। এই স্থাপনাটি হলো কাবুস ইবনে ভোশ্মগিরের সমাধি টাওয়ার”।
গোম্বাদ ইটের টাওয়ার ইরানে বিদ্যমান ইসলামী স্থাপত্যের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু। এই ভবনের উচ্চতা ৫৫ মিটার। আশেপাশের ভূমির চেয়ে ১৫ মিটার উঁচু একটি টিলার ওপরে এটি অবস্থিত। আলে যিয়র রাজবংশের নামকরা বাদশাহ ‘কাবুস বিন ভুশ্মগীর’ সেই ১০০৭ খ্রিষ্টাব্দে এই টাওয়ারটি নির্মাণ করেন।
গোম্বাদে কাবুস টাওয়ারটির একটা আধ্যাত্মিক মর্যাদা তো রয়েছেই সেইসাথে এই টাওয়ারটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেরও একটি অন্যতম নিদর্শন। এই টাওয়ারটি কাফেলার পথ প্রদর্শকের দায়িত্ব পালন করতো। টাওয়ারটি বাইরের দিকটা দশ কৌণিক আর ভেতরেরটা গোলাকার বৃত্তের মতো। বাইরের প্রতিটি অংশে কুফি অক্ষরের ক্যালিগ্রাফির কাজ রয়েছে। মাঝখানে একটি সাইনবোর্ড লক্ষ্য করা যাবে যাতে লেখা রয়েছে টাওয়ার নির্মাণের বিভিন্ন তথ্য। গোম্বাদে কাবুস টাওয়ারটির এতোসব বিশেষত্বের দিক বিবেচনায় নিয়ে ইউনেস্কো ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এই স্থাপনাটিকে আন্তর্জাতিক ঐতিহ্যের নিদর্শনের তালিকাভুক্ত করেছে।#
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/১৯
খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন