আগস্ট ২৫, ২০১৮ ১৮:৫৯ Asia/Dhaka
  • দেখব ঘুরে ইরান এবার:  তুর্কামান ও তাদের তৈরি হস্তশিল্প সামগ্রী

তুর্কামানদের মাঝে হস্তশিল্পের আলাদা একটা অবস্থান ও মর্যাদা রয়েছে। তুর্কামানরা এমনিতে কৃষিকাজ করে কিংবা পশুপালন করে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করে। কৃষিকাজের পাশাপাশি তারা হস্তশিল্প সামগ্রী তৈরি করে নিজেদের প্রয়োজনীয়তা মেটায়। তুর্কামানদের হস্তশিল্পের মধ্যে রয়েছে গালিচা বোনা, গেলিম বোনা, জাজিম বোনা, পশমি বস্ত্র বোনা ইত্যাদি।

সাধারণত মহিলারাই এই কাজগুলো বেশি করে। ফলে বলা যায় তুর্কামানদের পরিবারের অর্থনৈতিক যোগান যারা দেয় তাদের মধ্যে মহিলাদেরও একটা বিরাট ভূমিকা রয়েছে।

এই হস্তশিল্পের বাইরেও তুর্কামান মহিলারা সুঁচিকর্ম, রেশম গুটি লালন পালন করা, তাঁতের কাপড় বোনা ইত্যাদি কাজও করে থাকে। তবে সুঁই সুতার কাজগুলো সাধারণত নিজেদের ব্যবহারের প্রয়োজনেই করা হয়, এগুলো খুব বেশি একটা বিক্রি করার উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয় না। তুর্কামানদের তৈরি হস্তশিল্পের মাঝে গালিচা বোনার ঐতিহ্যই সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধ। সমৃদ্ধ এই হস্তশিল্পটি নিয়ে চলুন আরো কিছুটা সময় কাটানো যাক।

তুর্কামান মহিলারা যেই হস্তশিল্পটির পেছনে নিজেদের শ্রম ও সময়ের সবচেয়ে বেশি অংশ ব্যয় করে তাহলো গালিচা বোনা। একথা বলাটা বোধ হয় অতিশয়োক্তি হবে না যে তুর্কামান শহরের অধিবাসীই হোক কিংবা গ্রামের অধিবাসীই হোক সবার ঘরেই মোটামুটি অন্তত একটা করে হলেও গালিচা বোনার তাঁত আছে। তুর্কামান অঞ্চলে গালিচা বোনার শিল্পটি কেবলমাত্র তুর্কামান মহিলা ও মেয়েদের মধ্যেই প্রচলিত। বলা যায় মেয়েরাই এই শিল্পটির জননী এবং পরিবারের মহিলারা অর্থাৎ মায়েরা মেয়েদেরকে টাকা-পয়সা দিয়ে সহযোগিতা করে এই শিল্পটির সাথে নিজেকে জড়াবার জন্যে। গালিচা বুনন শিল্পটি মাতৃকেন্দ্রিক বা মহিলাকেন্দ্রিক হবার কারণে একেবারে ছোটোবেলা থেকেই পরিবারের নারী সদস্যরা গালিচা বোনার কাজটি আয়ত্ত করে ফেলে।

গালিচার অর্থনৈতিক মূল্যের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া এর অন্যান্য রকম গুরুত্বও রয়েছে। যেমন বিয়ে শাদির ক্ষেত্রে গালিচা বোনার কাজে মেয়ে কতোটা নিপুণ সে বিষয়টিও দেখা হয়। এই শিল্পে নৈপুণ্যও কণের অন্যতম একটি যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হয়। তুর্কামানদের দৃষ্টিতে গালিচার বস্তুগত ঐতিহ্যের পাশাপাশি এই শিল্পটির সাংস্কৃতিক মূল্যও অপরিসীম। গালিচার ওপর নারীরা যেসব চিত্র বা নকশা এঁকেছে যুগ যুগ ধরে সেগুলো নিয়ে গবেষণা করলে দেখা যাবে তুর্কামানী গালিচার পটে শিল্পের আকারে সংরক্ষিত রয়েছে সেই এলাকার লোক বিশ্বাস, রীতি রেওয়াজ, লোকজ সাহিত্য ও সংস্কৃতির নানা উপাদান। সমাজে বিরাজমান মূল্যবোধগুলো অত্যন্ত সহজ সরল নকশার মাধ্যমে সচিত্র ইতিহাস হয়ে সংরক্ষিত আছে গালিচাগুলোর ক্যানভাস জুড়ে।এখানেই এই গালিচাগুলোর ঐতিহাসিক মূল্য নিহিত। তুর্কামানের গালিচার সাথে ইরানের অপরাপর অঞ্চলের গালিচার প্রধান পার্থক্যটা হলো রঙের ব্যবহারে। তুর্কামানী গালিচায় হার্বাল রঙ ব্যবহার করা হয়।              

পশমি বস্ত্র বোনা তুর্কামান মহিলাদের মধ্যে প্রচলিত আরেকটি প্রাচীন পেশা। নাম থেকেই বুঝতে পারা যায় যে পশমি বস্ত্র তৈরির মূল উপাদান হলো পশম। যারা পশুপালন করে তাদের কাছ থেকে এই পশম সংগ্রহ করা হয়। আর তুর্কামানের লোকজনের মাঝে পশু পালনের প্রচলন ব্যাপক পরিমাণে ছিল এবং আছে। নিজেদেরই যেহেতু পশমের যোগানের ব্যবস্থা আছে সুতরাং এই উপাদানটি তুর্কামানে মোটামুটি শস্তাই বলা যায়। তাছাড়া উৎপাদিতও হয় প্রচুর। নিজেদের প্রয়োজনেই এই শিল্পটি গড়ে উঠেছে তাদের মাঝে। যারা যাযাবর, সারা বছর ধরেই এক এলাকা থেকে অপর এলাকায় ঘুরে বেড়ায় তাদের পশমি বস্ত্রের প্রয়োজন হয় বেশি। সে কারণে তাঁবুবাসী এই উপজাতীয়দের মাঝে পশমি বস্ত্র বোনার পেশাটি গড়ে উঠেছে ভালোভাবেই।

পশমি বস্ত্র একদিকে যেমন ঠাণ্ডা প্রতিরোধী অপরদিকে আর্দ্রতাও প্রতিরোধ করে। সেজন্যে শীতের সময় এই বস্ত্র খুবই প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়ায় তাঁবুবাসীদের মাঝে। সাধারণত নারীদের অংশগ্রহণেই যৌথ এই শিল্প মাধ্যমটির কাজ হয়ে থাকে। কয়েকটি পর্বে একটি পশমি বস্ত্রের কাজ শেষ হয়। পশমি বস্ত্রগুলো পশমের প্রাকৃতিক রঙ ধারণ করে। তার মানে পশমের যে কয়টি রঙ হয় ওই কয়টি রঙেরই পশমি বস্ত্র তৈরি হয়। যেমন কালো, সাদা, ধূসর এবং কফি বা খয়েরি রঙের পশমি বস্ত্রই বেশি হয়। তবে লাল রঙের বস্ত্র করার জন্যে অনেক সময় ভেষজ লাল রঙ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তুর্কামানরা পশমি বস্ত্রের বিচিত্র ব্যবহার করে থাকে। মাদুর হিসেবে ব্যবহার করা ছাড়াও পশমি বস্ত্রগুলো রাখালদের গরম পোশাক কিংবা ঘোড়ার গায়েও শীতবস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

গেলিম বোনার প্রচলনও তুর্কামান মহিলাদের মাঝে লক্ষ্যণীয় একটি পেশা। গেলিম অনেকটা কার্পেটের মতোই, তবে আকারে ছোটো। যেমন অনেকটা জায়নামাযের মতো। কিংবা তারচেয়ে আরেকটু বড়োও হয়। তবে কার্পেটের মতো ততোটা মোটা কিংবা ভারি নয়, হালকা পাতলা। মাদুর হিসেবে, নামাযের মোসাল্লা হিসেবে শহর গ্রামের ঘরে ঘরে আজো এই গেলিমের ব্যবহার আগের মতোই অব্যাহত আছে। কার্পেট বোনা আর গেলিম বোনার প্রক্রিয়াতেও অনেক পার্থক্য রয়েছে। গেলিম অনেকটা কাপড় বোনার মতোই।

তুর্কামান মহিলাদের মাঝে আরেকটি হস্তশিল্প তৈরির প্রচলন ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যায়। এই শিল্পটি হলো সুঁচিকর্ম। সুঁই সুতা দিয়ে বিচিত্র রকমের কারুকাজ। বিচিত্র রঙের সুতা দিয়ে চমৎকার সব নকশা তৈরি করে তুর্কামান মহিলারা। সাধারণত মহিলারা যেসব হ্যাট পরে সেগুলোতেই বেশি কারুকাজ করা হয়। ছেলেদের হ্যাটেও কাজ হয় তবে তুলনামূলকভাবে একটু কম। মহিলাদের জামা পায়জামাতেও প্রচুর নকশার কাজ করা হয়। তুর্কামান মহিলারা যে কতোটা সৃজনশীল এবং সুঁচিকর্মে নিপুণ তা এই জামা কাপড় দেখলেই বোঝা যায়। তবে তাদের তৈরি করা নকশায় স্থানীয় ঐতিহ্যের ছাপ সুস্পষ্ট। তুর্কামান অঞ্চলে এমন কোনো মহিলা বোধ হয় পাওয়া যাবে না যে কিনা এই শিল্পটির সাথে পরিচিত নয়। তবে এই শিল্পটি পেশা হিসেবে গড়ে ওঠে নি। নিজেদের প্রয়োজনেই এ কাজটি তারা করে, বাজারে বিক্রি করার জন্যে নয়। তুর্কামান মহিলাদের স্থানীয় বিশেষ পোশাকের নাম হলো ‘কুইনাক’।

মহিলাদের রকমারি অলংকারও তুর্কামানের হস্তশিল্পের আরেকটি উদাহরণ। তবে এই শিল্পটি মহিলারা নয় পুরুষরাই তৈরি করে থাকে। এখানকার মহিলাদের অলংকারগুলো সত্যিই সুন্দর, একেবারে অনন্য সাধারণ।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/ ২৫

খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন