বাংলাদেশে নানা আয়োজনে বর্ষবরণ উৎসব অনুষ্ঠিত: বিভিন্ন মহলের প্রতিক্রিয়া
উৎসবপ্রিয় বাঙালির জীবনে বর্ষ পরিক্রমায় আবারো ফিরে এসেছে পহেলা বৈশাখ; বাংলা নববর্ষ ১৪২৬ বঙ্গাব্দ। নতুন বছরকে বরণ করে নিতে নানা উৎসব অয়োজনের পর্ব চলছে শহর-নগর, গঞ্জ-গ্রাম, হাট-বাজার, দোকান-পাট আর গৃহস্থের বাড়িতে।
পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আয়োজন করা হয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মঙ্গল শোভাযাত্রা আর বৈশাখি মেলা। এছাড়াও আয়োজন করা হয়েছে ঘুড়ি কাটাকাটি প্রতিযোগিতা, চৈত্র সংক্রান্তির চড়ক উৎসব, ঘোড়দৌড় এবং নতুন হালখাতা খোলার মিষ্টি বিতরণ।
রাজধানী কেন্দ্রীক অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে বরাবরের মতো এবারও বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নিয়েছে সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট। রোববার ভোর সোয়া ছয়টার দিকে রমনার বটমূলে ছায়ানটের ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণের অনুষ্ঠান শুরু হয়। ছায়ানটের বর্ষবরণের এবারের প্রতিপাদ্য ‘অনাচারের বিরুদ্ধে জাগ্রত হোক শুভবোধ’।
ওদিকে ঢাকা বিশ্বিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট সকাল ৯টায় আয়োজন করে মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঐতিহ্য অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি শোভাযাত্রার উদ্বোধন করেন। অংশ নেন প্রতিষ্ঠানের অন্য শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ দেশ-বিদেশের অসংখ্য মানুষ।
এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য ‘মস্তক তুলিতে দাও অনন্ত আকাশে’।
আজকের মঙ্গল শোভাযাত্রায় ছিল মূল আটটি শিল্পকাঠামো। বাঘের মুখ থেকে কাঁটা তোলার চিরায়ত গল্পটি উপস্থাপিত হয়েছে বাঘ ও বকের অনুষঙ্গে। মঙ্গলের বার্তা প্যাঁচা। সমৃদ্ধির কথা বলেছে ছাগল আর সিংহের সমন্বয়ের বিশেষ মোটিভ। লোকজ ঐতিহ্যের চিত্র মেলে ধরেছে গাজির পটের গাছ। এ ছাড়া অনুষঙ্গের মধ্যে ছিল দুই মাথা ঘোড়া, দুই পাখি, কাঠঠোকরা। ছিল স্বপ্নের পঙ্খিরাজ ঘোড়ায় সওয়ার মানুষ।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে জাতিসংঘের সংস্থা ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় আন্তর্ভক্ত করা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে ত্রিশ বছর আগে শুরু হওয়া এ মঙ্গল শোভাযাত্রা।
ওদিকে শেরে বাংলানগরস্থ বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের উন্মুক্ত চত্বরে সাংস্কৃতিক সংগঠন সুরের ধারার উদ্যোগে হাজারও কণ্ঠে ‘তোমার কাছে এ বর মাগি, মরণ হতে যেন জাগি'- গানের সুরে বরণ করা হয় বাংলা নববর্ষ ১৪২৬। এই সময়ে উপস্থিত ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোতে শেরিং এই বর্ণিল উৎসবে যোগ দিয়ে অনুষ্ঠানটিকে তাৎপর্যময় করে তোলেন।
গানে গানে বর্ষবরণের পাশাপাশি আয়োজন করা হয়েছে বৈশাখী মেলার। মেলার স্টলগুলো সাজানো হয়েছে বাঙালির ঐতিহ্যের নানা উপাদান দিয়ে। এর মধ্যে মধ্যে রয়েছে পিঠা-পুলি, মাটির তৈরি তৈজস, বেত, কাঁথা, পিতল, পাট ও পাটজাত দ্রব্যের নানা জিনিসপত্রসহ রকমারি পণ্যের সমাহার।
অপরদিকে, ১৪২৬ কে বরণ করে নিতে রোববার রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউয়ে আয়োজন করা হয় আল্পনা উৎসবের। কর্মসূচির উদ্বোধন করেন জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী।
এসময় তিনি ভেদাভেদ ভুলে দেশকে এগিয়ে নিতে নববর্ষে সবাইকে একসাথে কাজ করার আহ্বান জানান। এছাড়া বিভিন্ন জেলার মতো সমূদ্র উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালিতেও আয়োজন করা হয়েছে ঐতিহ্যবাহী ঘুড়ি উৎসব।
পাবনার চাটমোহরে বড়াল নদের তীরে বোঁথর গ্রামে শুরু হয়েছে হাজার বছরের ঐহিত্যবাহী চড়ক পূজা ও মেলা। শনিবার থেকে শুরু হওয়া তিনদিনব্যাপী এই মেলা শেষ হবে আগামী সোমবার (১৫ এপ্রিল)। হিন্দু সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে হাজার বছর ধরে চলে আসা এই চড়ক মেলা এখন একটি সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ছাড়াও পশ্চিম বাংলা থেকেও পুণ্যার্থীরা চড়কের মেলায় যোগ দিতে এসেছেন। মেলা প্রাঙ্গণে বসেছে নাগরদোলা। নানা ধরেণের পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানীরা।
এ উপলক্ষে শনিবার বিকেল ৫টায় বোঁথর মহাদেব মন্দির প্রাঙ্গনে নব নির্মিত শ্রী শ্রী হরিমন্দির ও নাট মন্দিরের শুভ উদ্বোধন করেছেন ভারতীয় দূতাবাসের রাজশাহী অঞ্চলের সহকারী হাইকমিশনার সঞ্জিব কুমার ভাট্টি।
এতো কিছু উৎসব অযোজনের মাঝেও অভিনেত্রী দিলারা জামানের মতে, বৈশাখ আগে ছিল পরিবারের সবাই মিলে একসঙ্গে আনন্দ করা। কিন্তু এখন আনন্দগুলো আর পরিবারভিত্তিক নেই। কোনো উপলক্ষে মানুষ আর পরিবারের সঙ্গে ঘরে সময় কাটানোর কথা ভাবে না। সব পরিকল্পনা এখন বাহির অঙ্গণে। তার মতে এই আনন্দটা 'লোক দেখানো' 'শো-অফের' আনন্দ।
ওদিকে পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ‘নগ্নযাত্রা’ উল্লেখ করে তা বন্ধের দাবিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিক্ষোভ করেছেন কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীরা। শনিবার বিকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার প্রধান মাদ্রাসা কান্দিপাড়াস্থ জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসা সামনে থেকে কওমি ছাত্র ঐক্য পরিষদের উদ্যোগে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়ে শহরের প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাবের সামনে এসে শেষ হয়। পরে সেখানে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
এই সময় বক্তারা বলেন, পহেলা বৈশাখ হিন্দু সংস্কৃতি। এটাকে বাঙালি সংস্কৃতি বলা যাবে না। যদি হিন্দুরা পহেলা বৈশাখ পালন করতে চায় তাহলে আমাদের কোনো বাধা নেই। কিন্তু পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রার নামে নগ্নযাত্রা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চলবে না। বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ মানুষ মুসলমান। আমরা আশা করব সরকারের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে এবং মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধ করবে।
এর আগে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ নামের একটি ইসলামী সংগঠন শনিবার এক বিবৃতিতে বাংলা নববর্ষবরণের নামে পহেলা বৈশাখ বিভিন্ন জীব-জন্তুর মূর্তি নিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা, মুখে উল্কি আঁকা এবং অনাত্মীয় নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণসহ অনৈসলামিক ও ঈমান-আকিদা বিরোধী সংস্কৃতি থেকে দূরে থাকতে মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
উল্লেখ্য, ভারতবর্ষে মুঘল সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাট হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করতেন। মুঘল সম্রাট আকবর সুষ্ঠভাবে খাজনা আদায়ে লক্ষ্যে প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। সম্রাটের আদেশ মতে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। সে হিসেব অনুযায়ী ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ মার্চ (ভিন্নমতে ১১ মার্চ) থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়।#
পার্সটুডে/আবদুর রহমান খান/আশরাফুর রহমান/১৪