ডিসকভার ইরান:
মাখুনিক: দক্ষিণ খোরাসানের 'লিলিপুট গ্রাম' ও তার শতাব্দীপ্রাচীন রহস্য
পার্সটুডে: ইরানের দক্ষিণ খোরাসান প্রদেশের বীরজন্দ শহর থেকে প্রায় ১৪৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মাখুনিক গ্রাম—বিশ্বের সাতটি সবচেয়ে আশ্চর্যজনক গ্রামের একটি। এই গ্রামের ডাকনাম পড়েছে “লিলিপুটদের গ্রাম”।
প্রায় এক শতাব্দী আগেও এখানকার অধিকাংশ মানুষের উচ্চতা ছিল এক মিটারেরও কম। তারা বাস করতেন তাদের ছোট্ট শরীরের সঙ্গে পুরোপুরি মানানসই এমন ঘরে। প্রেসটিভির বরাত দিয়ে পার্সটুডে জানিয়েছে, মাখুনিকের অসাধারণ অতীত ও একে অপরের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে গড়ে ওঠা মাটির ঘরগুলো সবসময় পর্যটক ও গবেষকদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে।
মাখুনিকের গল্প কল্পকাহিনী আর নৃতত্ত্বের অদ্ভুত মিশ্রণ। জোনাথন সুইফট গালিভারের ভ্রমণে যে কাল্পনিক 'লিলিপুট' দেশের বর্ণনা দিয়েছিলেন, সেখানে ছোট্ট মানুষেরা সত্যিই বাস করত।
গ্রামের স্থাপত্য, মাটির ঘরের নিচু ছাদ, সরু দরজা আর মাটির নিচে তৈরি মেঝে—সবই ইরানের সবচেয়ে দুর্গম এলাকার শারীরিক ও পরিবেশগত অবস্থার প্রতিফলন।
সময়ের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া এক গ্রাম
স্থানীয়রা 'মাখুনিক' নামের যে ব্যাখ্যা দেন, তাতে রহস্যের ছোঁয়া লেগে আছে। কেউ বলেন এলাকার ঠান্ডা আবহাওয়ার কথা, কেউ বলেন পার্শ্ববর্তী পাহাড়ের ফাটলের কথা। আরেকটি মত, নামটি এসেছে প্রাচীন পাহলভি ভাষার দুটি শব্দ থেকে: 'মাহ' (চাঁদ) এবং 'খুনিক' (স্থান)—অর্থাৎ 'চাঁদের দেশ'।
রোদে পোড়া টিলা আর পাথুরে মাটির মাঝে অবস্থিত এই গ্রাম দেখতে যেন ঢালে ঝুলে থাকা মাটির ঘরের একটি গুচ্ছ।
মাখুনিকের ঘরগুলো ভূমির নিচে আধা–পোতা। শীতে উষ্ণতা ও গ্রীষ্মে শীতলতা ধরে রাখতে এই নকশা ছিল উপযোগী। ঘরের দরজার উচ্চতা প্রায় এক মিটার—যে কেউ প্রবেশ করতে চাইলে প্রথমে মাথা নত করতেই হয়। ভেতরে মেঝে মাটির স্তরের এক-দুই ধাপ নিচে, আর ঘরের আকৃতি অনিয়মিত—যাতে পাহাড়ের ঢালের সঙ্গে মিলে যায়।
পুরাতাত্ত্বিক গবেষণায় জানা গেছে—মাখুনিকের ইতিহাস কয়েক শতাধিক বছরের পুরোনো। স্থানীয় প্রবীণরা বলেন, গ্রামের উৎপত্তি সাফাভি আমল পর্যন্ত গড়ায়। কিছু ঐতিহাসিক মনে করেন, সাফাভি শাসকেরা তাদের পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্ত–নীতির অংশ হিসেবে এ অঞ্চলের উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছিলেন। গ্রামের আশেপাশের প্রাচীন শিলালিপি অবশ্য আরও প্রাচীন মানব বসতির প্রমাণ দেয়।
মাখুনিকের মানুষ খাটো হল কীভাবে?
মাখুনিকের মানুষের উৎস অভিবাসনের সঙ্গে জড়িত। লোক মুখে শোনা যায়, প্রায় ৪০০ বছর আগে আফগানিস্তানের একটি পরিবার দুঃসময় এড়াতে ইরানের এই দুর্গম এলাকায় এসে বসতি স্থাপন করে।
প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তারা একটি ছোট্ট, অভ্যন্তরীণ সম্প্রদায় গড়ে তুলল যারা দীর্ঘদিন বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। বিয়ে হতো একই পরিবারের মধ্যে—এই নিকট-আত্মীয় বিবাহের রেওয়াজ শতাব্দীর পর শতাব্দী চলেছে।
শুষ্ক ও নির্মম পরিবেশে পশুপালন প্রায় অসম্ভব ছিল। কৃষি সীমাবদ্ধ ছিল শালগম, যব, কিছু শস্য আর খেজুরের মতো ফল ‘জুজুবে’ (এনাব)-এর চাষে। গ্রামবাসী মূলত নিরামিষভোজী ছিলেন, খাবার ছিল সাধারণ স্থানীয় উপকরণে তৈরি।
গবেষণা অনুযায়ী, গ্রামবাসীদের অস্বাভাবিকভাবে খাটো হওয়ার পেছনে তিনটি প্রধান কারণ ছিল— জেনেটিক কারণ ও ঘনিষ্ঠ–সম্পর্কের বিবাহ,
দারিদ্র্যজনিত অপুষ্টি ও খনিজ–স্বল্প পানি এবং স্থানীয় কূয়াগুলোতে স্বল্পমাত্রার পারদের উপস্থিতি—যা কিছু প্রতিবেদনে উল্লেখ ছিল। এই সব কারণ মিলিয়ে, গবেষকদের মতে, মাখুনিকের মানুষের গড় উচ্চতা প্রতিবেশী অঞ্চলের মানুষের তুলনায় প্রায় অর্ধ মিটার কম ছিল।
বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে রাস্তা তৈরি হওয়া, চিকিৎসা ও পুষ্টির সুযোগ বৃদ্ধির ফলে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। আজকের মাখুনিকের অধিকাংশ বাসিন্দার উচ্চতা স্বাভাবিক, যদিও পূর্বপুরুষদের ছোট্ট কদের চিহ্ন এখনো কারো কারো মধ্যে রয়ে গেছে।
মাখুনিকের স্থাপত্য ও সংস্কৃতি
মাখুনিকের ২০০টি কাঁচামাটি ও পাথরের ঘরের মধ্যে ৭০–৮০টির উচ্চতা অত্যন্ত কম; সিলিং মাত্র ১.৪ থেকে ২ মিটার। ঢাল, রোদ আর কঠিন আবহাওয়ার সঙ্গে মিল রেখে বাড়িগুলো নির্মিত। মাটির রংয়ের ঘরগুলো একসময় সীমান্তের ভবঘুরে বা আক্রমণকারীদের চোখ এড়ানোর মতো প্রাকৃতিক ছদ্মবেশও তৈরি করত।
যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইটের নতুন বাড়ি উঠেছে, তবু প্রাচীন স্থাপত্যই মাখুনিকের আকর্ষণের কেন্দ্র।
সংকীর্ণ গলি ধরে হাঁটলে দেখা যায়—অর্ধ-পোতা ঘর, নিচু দরজা, ঢালু দেয়াল—যা যেন অতীত থেকে বয়ে এসেছে।
গ্রামের সংস্কৃতি ও রীতিনীতিও দর্শকদের বিস্মিত করে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মাখুনিকবাসী কঠোর নৈতিক নিয়ম মেনে চলতেন—ধূমপান, শিকার বা মাংস খাওয়া ছিল নিষিদ্ধ। বুড়োরা এগুলোকে পাপ মনে করতেন। একসময় চা খাওয়াও ছিল ট্যাবু—কিছুটা ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে, কিছুটা বাণিজ্যিক যোগাযোগের অভাবে।
টেলিভিশনও দশকের পর দশক প্রতিরোধ করা হয়েছিল, পুরোনো প্রজন্মের কাছে তা ছিল 'অশুভ শক্তির প্রবেশদ্বার'।
সময়ের স্রোতে এই রীতিগুলো বদলে গেছে, কিন্তু গভীর রক্ষণশীলতা ও বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির ছাপ এখনো রয়ে গেছে।
আজকের ইরানে মাখুনিক দাঁড়িয়ে আছে কিংবদন্তি আর বাস্তবতার সীমারেখায়। যারা এর মাটির গলিতে পা রাখেন, তাদের কাছে এই গ্রাম যেন এক জীবন্ত প্রমাণ—কীভাবে মানব সম্প্রদায় টিকে থাকে, রূপান্তরিত হয় এবং সভ্যতার গল্পকে নতুন করে অর্থ দেয়।#
পার্সটুডে/এমএআর/২২