ট্রাম্প কেন ভাবছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইরান সম্পর্কে তার মিথ্যাচার বিশ্বাস করবে?
-
জাতিসংঘে বক্তৃতার সময় ডোনাল্ড ট্রাম্প
পার্সটুডে-জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট তার বক্তৃতায় আবারও ইরানের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন দাবি করেছেন।
পার্সটুডে আরও জানায়, বিতর্কিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ইরানের বিরুদ্ধে তার দাবির পুনরাবৃত্তি করেছেন এবং ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর সর্বাধিক বিস্তৃত পরিদর্শনের কথা উল্লেখ না করে বলেছেন: ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র থাকা উচিত নয়। তিনি দাবি করেছেন যে ইরান সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করে এবং একইসাথে স্পষ্টভাবে বলেছেন: তার দেশ ইহুদিবাদী ইসরাইলের সাথে যোগসাজশে ইরানের মাটিতে আক্রমণ করেছে।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির বিষয়ে আমেরিকার অবস্থান জানাতে তিনি ইরানের সর্বোচ্চ নেতাকে একটি চিঠি লিখেছিলেন বলে দাবি করে ট্রাম্প বলেছেন: ইরানের প্রতিক্রিয়া হল তার পারমাণবিক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া। ইসরাইল বিশ্বের একমাত্র দখলদার শক্তি যে পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি বা এনপিটিতে স্বাক্ষর করে নি-সেই সত্য উল্লেখ না করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেছেন: "পারমাণবিক অস্ত্রের উন্নয়ন রোধ করতে, আমাদের ইরান দিয়ে শুরু করতে হবে।" ট্রাম্প দাবি করেছেন যে আমেরিকা ছাড়া বিশ্বের আর কোনও দেশ ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করতে সক্ষম হয় নি।
ট্রাম্প বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়ে তার গর্বিত এবং আশ্চর্যজনক দাবি অব্যাহত রেখে আরও দাবি করেন যে, সাত মাসের মধ্যে তিনি সাতটি অন্তহীন যুদ্ধের অবসান ঘটিয়েছেন, যার মধ্যে কয়েকটি ৩১ বছর, একটি ৩৬ বছর এবং একটি ২৮ বছর ধরে চলছিল। তিনি এই যুদ্ধগুলোকে কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ড, কসোভো ও সার্বিয়া, কঙ্গো ও রুয়ান্ডা, পাকিস্তান ও ভারত, ইসরাইল ও ইরান, মিশর ও ইথিওপিয়া, আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যকার যুদ্ধ বলে অভিহিত করেছেন। ট্রাম্প আগে যে দাবি করেছিলেন, তা ভারতের মতো দেশগুলো অস্বীকার করেছে। এছাড়াও, একদিনে ইউক্রেনের যুদ্ধ শেষ করার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরেও তিনি এ ক্ষেত্রে কোনও সাফল্য পান নি।
এদিকে ট্রাম্প, যেমনটি আশা করেছিলেন, জাতিসংঘে তার বক্তৃতায় ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রচেষ্টা এবং সন্ত্রাসবাদের প্রতি ইরানের কথিত সমর্থন সম্পর্কে মিথ্যাচার ছড়িয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন।
কিন্তু ট্রাম্প এবং তার প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তা যেসব কারণে বিশ্বাস করেছিলেন যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইরান সম্পর্কে তাদের মিথ্যাচার বিশ্বাস করবে, সেগুলোকে এভাবে তালিকাভুক্ত করা যেতে পারে:
১. রাজনৈতিক এবং কৌশলগত এজেন্ডা: ট্রাম্প তার প্রেসিডেন্টের মেয়াদকালে, অবশ্যই তার নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের সাথে সঙ্গতিপূর্ণভাবে তাদের পররাষ্ট্র নীতি সমন্বয় করার চেষ্টা করেছেন। এই নীতিগুলোর মধ্যে একটি হল সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে ইরানের উপর কঠোরতা আরোপ করা, বিশেষ করে তেল রপ্তানি বন্ধ করা, পাশাপাশি ইরানের সাথে অন্যান্য দেশের সম্পর্ক হ্রাস বা ছিন্ন করার চেষ্টা করা। অতএব, ইরানের বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং মিথ্যাচার, বিশেষ করে পারমাণবিক কর্মকাণ্ড ও সন্ত্রাসবাদের প্রতি সমর্থনের ভিত্তিহীন দাবীকে তিনি তেহরানের ওপর চাপ বৃদ্ধি করা এবং আমেরিকার দাবি মেনে নিতে বাধ্য করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
২. ইরানের নেতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরা: প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার প্রথম মেয়াদে, ট্রাম্প JCPOA মানে পারমাণবিক চুক্তির তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন এবং চুক্তি থেকে সরে এসে বিশ্বব্যাপী জনমতের মধ্যে ইরানের একটি নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন। ট্রাম্প তার দ্বিতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রপতি হিসেবে এই পদ্ধতিটি আরও তীব্রভাবে অনুসরণ করেন এবং সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রেখে কিংবা আরও সম্প্রসারিত করে ইরানভীতি প্রচার করেন এবং ইরানকে নানাভাবে অভিযুক্তও করেন। এই নেতিবাচক ভাবমূর্তি ট্রাম্পকে ভবিষ্যতে ইরানের সাথে যে-কোনো বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে বা অন্যান্য দেশকে ইরানের সাথে সম্পর্ক কমাতে কিংবা ছিন্ন করার জন্য অনুরোধ করার ক্ষেত্রে চাপ প্রয়োগের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ দেয়।
৩. ইসরাইলের প্রতি সমর্থন জোরদার করা: ইরানকে অভিযুক্ত করার আরেকটি কারণ, বিশেষ করে জাতিসংঘের মঞ্চ থেকে যেখানে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সাধারণত মার্কিন প্রেসিডেন্টের বার্ষিক ভাষণে উপস্থিত থাকেন, তা হল ইরানের কাছ থেকে হুমকি তৈরির অজুহাত দেখিয়ে ইহুদিবাদী ইসরাইলের প্রতি ব্যাপক সমর্থন আদায় করা। সেইসাথে ইসরাইলকে সামরিক ও অস্ত্র সহায়তা দেওয়ার ঘটনাকে ন্যায্যতা দেওয়ার প্রচেষ্টা চালানো। ট্রাম্প তার রাষ্ট্রপতিত্বকালে, সর্বদা ইসরাইলের একজন শক্তিশালী সমর্থক ছিলেন এবং জেসিপিওএ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করা এবং ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করাসহ তার অনেক নীতি ইসরাইলের স্বার্থ এবং লক্ষ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল। বিশেষ করে যেহেতু ইহুদিবাদী ইসরাইল সর্বদা ইরানকে দুর্বল এবং বিচ্ছিন্ন করার এবং বিশ্বব্যাপী ইরান সম্পর্কে একটি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করার চেষ্টা করেছে।
৪. অভ্যন্তরীণ বিবেচনা: এছাড়াও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে, কিছু রাজনৈতিক অভিজাত এবং নির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠী (বিশেষ করে কট্টর রিপাবলিকান গোষ্ঠী এবং AIPAC-এর মতো বিভিন্ন ইহুদিবাদী লবির সাথে ট্রাম্পের জোট) ইরান এবং তাদের কার্যকলাপের তীব্র বিরোধিতা করে। এক্ষেত্রে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ইরানের নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করার জন্য ট্রাম্পের জেদকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। পরিশেষে, ট্রাম্প এবং তার প্রশাসনের অন্যান্য উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের, যেমন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এবং যুদ্ধ সচিব পিট হেক্সাথের ইরানের প্রতি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনা করলে মনে হয় যে ইরানকে দোষারোপ এবং নিন্দা করার জেদ আমেরিকার ভূ-রাজনৈতিক ও কৌশলগত লক্ষ্যগুলোকে এগিয়ে নেওয়া এবং ইসরাইলের স্বার্থ রক্ষার একটি কৌশল।#
পার্সটুডে/এনএম/২৪
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।