মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি- ৬৩ : বিশিষ্ট ফকিহ এবং তাঁদের মূল্যবান অবদান
আজকে আমরা ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির ওপর প্রভাব বিস্তারকারী জ্ঞানের আরো একটি নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করবো। এই শাখাটির নাম হলো 'ফিকাহ'। ফিকাহ হলো ইসলামী বিধি-বিধান বা আইন শাস্ত্র। স্বাভাবিকভাবেই এই জ্ঞানের পরিধি অনেক বিস্তৃত।
মানুষের ব্যবহারিক জীবনের প্রয়োজনীয় সকল বিষয় আশয় এবং সমস্যার ইসলাম ভিত্তিক সমাধান নিয়ে এই শাস্ত্রে আলোচনা করা হয়েছে। ইসলামের ইতিহাসে বহু ফকিহ এসেছেন এবং ব্যাপক খেদমত করে গেছেন। আমরা আজকের আসরে বিশিষ্ট ফকিহ এবং তাদেঁর মূল্যবান অবদান নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করবো।
ফিকাহর দুটি ধারা ইসলামের ইতিহাসে সমান্তরালভাবে এগিয়ে গেছে। একটি সুন্নি ফিকাহর ধারা এবং অপরটি শিয়া ফিকাহর ধারা। আহলে সুন্নাতের ফিকাহর ধারা বহু যুগ অতিক্রম করেছে। ইসলামের শুরু থেকে এগারো হিজরি পর্যন্ত যুগটিতে রাসূলে খোদা (সা) এর জীবদ্দশায় ফিকাহর ক্ষেত্রে সবাই কোরআন এবং রাসূলে খোদার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। পরবর্তী যুগটি ছিল সাহাবিদের যুগ। এই যুগটি এগারো হিজরি থেকে মোটামুটি চল্লিশ হিজরি পর্যন্ত। এই যুগটিতে মুসলমানরা রাসূলে খোদা (সা) এর পবিত্র উপস্থিতির বরকত থেকে বঞ্চিত ছিলেন। সাহাবায়ে কেরামের মাধ্যমে নবীজীর সীরাত সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেন। চল্লিশ থেকে এক শ' হিজরি পর্যন্ত সময়টা ছিল তাবেয়িনদের যুগ। তাবেয়িন মানে হলো যাঁরা সাহাবায়ে কেরামকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। এই যুগেও মুসলমানরা একটি মাধ্যমের সাহায্যে নবীজির সাথে যোগাযোগের সেতুবন্ধন তৈরি করেছিলেন এবং নবীজীর হাদিস উদ্ধৃত করেছিলেন।
পরবর্তী পর্বটি হিজরি দ্বিতীয় শতক থেকে চতুর্থ শতক পর্যন্ত বিস্তৃত। এ সময়কার আহলে সুন্নাতের ফিকাহ চার ইমামি যুগ নামে প্রসিদ্ধ। ফিকাহ ভিত্তিক মাজহাব প্রতিষ্ঠারও যুগ বলা হয় এই পর্বটিকে। হিজরি চতুর্থ শতক থেকে পরবর্তী যুগও চার ইমামি তাকলিদের যুগ। মোটামুটি এই যুগের পর থেকে আইনী এবং ফিকহি নতুন ধারার সূত্রপাত ঘটে যা আহলে সুন্নাতের ফিকার জগতে ইজতিহাদ বা গবেষণার দ্বার উন্মোচন করে। আহলে সুন্নাতের ফিকাহ হিজরি দ্বিতীয় শতক থেকে চতুর্থ শতক পর্যন্ত পূর্ণতা পাওয়ায় এবং চার ইমামের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে ফিকাহ ভিত্তিক মাজহাব প্রতিষ্ঠার সূত্রপাত ঘটে। এখানে অবশ্য একটি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে সেটা হলো তৃতীয় খলিফার সময় কোরআনে কারিমকে সুবিন্যস্ত ও সঞ্চিত করা এবং দ্বিতীয় শতক থেকে হাদিসে নববীর একত্র সন্নিবেশ, বিভিন্ন রকমের মত ও বিশ্বাসের আবির্ভাব ইত্যাদি বিষয়ও আহলে সুন্নাতের ফিকাহ ভিত্তিক বিভিন্ন মাজহাব গড়ে ওঠার পেছনে কাজ করেছে। এছাড়াও অন্যান্য সংস্কৃতির সাথে মুসলমানদের পরিচিতি, বিভিন্ন মতবাদের আবির্ভাব, বিভিন্ন হুকুমাতের উন্নয়ন এবং অধিকার বা আইনী প্রয়োজনীয়তা বিস্তার ইত্যাদিও আহলে সুন্নাতের ফিক্হি মাজহাব সৃষ্টির কারণ বলে গণ্য করা হয়।

আহলে সুন্নাতের সর্বপ্রথম ফিক্হি মতাদর্শ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল "নুমান ইবনে সাবিত আবু হানিফা"র মাধ্যমে। আবু হানিফা ছিলেন ইরানী বংশোদ্ভুত। হিজরি আশি সালে কুফা শহরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। আহলে সুন্নাতের কাছে তিনি একজন বড়ো ফকিহ হিসেবে স্বীকৃত। আবু হানিফা তাঁর শিক্ষক হাম্মাদ বিন আবি সুলাইমানকে অনুসরণ করে নতুন একটি ফিকহি মতাদর্শের গোড়াপত্তন করেন। মৌলিক সাতটি ভিত্তির ওপর তাঁর মতাদর্শটি প্রতিষ্ঠিত। আল কোরআন, রাসূল (সা) এর সুন্নাত, সাহাবায়ে কেরামদের বক্তব্য, কিয়াস, এস্তেহসান, এজমা এবং সাধারণ বা প্রচলিত আইন। এই মতাদর্শ পরবর্তীকালে হানাফি মতাদর্শ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। সমকালীন শাসন ব্যবস্থা বা হুকুমাত হানাফি মাজহাবকে গ্রহণ করার কারণে এবং এই মতাদর্শের অনুসারী বিচারকদেরকে মুসলিম ভূখণ্ডের বিভিন্ন প্রান্তে প্রেরণ করার কারণে খুব দ্রুত এর প্রসার ঘটে। হানাফি ফিকাহ প্রথম ইরাকে, তারপর মিশরে, মধ্য এশিয়ায়, আনাতোলিয়া বা এশিয়া মাইনরে এবং উপমহাদেশ এমনকি চীনেও বিস্তৃতি লাভ করে। যদিও আবু হানিফা নিজেই তাঁর মতাদর্শের মূল ব্যাখ্যাকার ছিলেন,তারপরও তাঁর ছাত্ররাও এই মতাদর্শ বিস্তারে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল। অবশেষে ১৫০ হিজরিতে ইমাম আবু হানিফা ইহলোক ত্যাগ করেন।
আহলে সুন্নাতের দ্বিতীয় ফিকহী মাজহাবের প্রতিষ্ঠাতা হলেন "মালেক ইবনে আনাস"। তাঁর নামানুসারেই এই ফিকহি মাজহাবটিকে "মালেকি ফিকাহ" বলে অভিহিত করা হয়। মদিনার উত্তরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। সে সময় মদিনা ছিল ফিকাহ এবং হাদিস চর্চার মূল কেন্দ্র। ঐ কেন্দ্রেই তিনি লেখাপড়া শুরু করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি ফিকাহ শাস্ত্রে ব্যাপক ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। মদিনার মসজিদে নববীতে তিনি ছাত্রদের পড়ান এবং প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ফতোয়া জারি করেন। তাঁর ফিকাহর মূল ভিত্তি হলো সর্বপ্রথম আলকোরআন। তারপর হাদিস। এরপর আলেমদের এজমা। আর এজমার পরে মদিনাবাসীদের ব্যবহারিক দিক বা আমল। মালেক যেহেতু মদিনায় বড়ো হয়েছেন, সেজন্যে মদিনাবাসীদের ব্যবহারিক জীবনকে খুব গুরুত্ব দিতেন। তিনি প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে কিয়াস এবং এসতেহসানের ওপরও গুরুত্ব দিতেন। মালেকি ফিকাহ প্রথমে হেজাজে বিস্তার লাভ করে। তারপর মিশরে এবং মিশর থেকে উত্তর আফ্রিকা এবং স্পেনে বিস্তৃতি পায়।

আহলে সুন্নাতের তৃতীয় ফিকহী মতাদর্শের প্রবক্তা হলেন "আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন ইদ্রিস শাফেয়ি"। শাফেয়ি ১৫০ হিজরিতে গাযায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি হানাফি এবং মালেকি-উভয় মাজহাবের সাথেই পরিচিত ছিলেন। এই দুই মাজহাবের ওপর ভিত্তি করে তিনি নতুন আরেকটি মাজহাবের জন্ম দেন। তাঁর মাজহাবটি শাফেয়ি মাজহাব নাম খ্যাতি পায়। তাঁর মাজহাবটি সালাউদ্দিন আইয়্যুবির মাধ্যমে মিশরে প্রচলিত হয়। মক্কা এবং ইরাকেও তাঁর মাজহাবের ব্যাপক অনুসারী গড়ে ওঠে। অবশেষে ইমাম শাফেয়ি ২০৪ হিজরিতে ওফাত বরণ করেন।
শাফেয়ি'র পর 'আহমাদ ইবনে হাম্বল' আরেকটি মাজহাবের গোড়াপত্তন করেন। তার মাজহাবটি 'হাম্বলি' নাম ধারণ করে। ১৬৪ হিজরিতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইমাম শাফেয়ি (রহ) এর কাছে পড়েছেন। তাঁর ফিকাহর ভিত্তি ছিল কোরআন, সুন্নাতে রাসূল (সা), সাহাবাদের ফতোয়া, কেয়াস এবং এসতেহসান। হেজাজ অঞ্চলে তাঁর মাজহাবটি ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি পায়। অবশেষে ২৪১ হিজরিতে তিনি পরলোক গমণ করেন।
এই হলো মোটামুটি সুন্নি ফিকহি মাজহাবগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি। আজ আর হাতে যেহেতু সময় কম সেজন্যে পরবর্তী আসরে অন্যান্য ফিকহি মাজহাব বিশেষ করে শিয়া ফিকা এবং ফকিহদের সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবো।#
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবু সাঈদ/ ২২