আগস্ট ০৬, ২০১৮ ১৮:২১ Asia/Dhaka
  • দেখব ঘুরে ইরান এবার: কাস্পিয়ান সাগরের তীরে অবস্থিত 'চলুস' শহরের অপরূপ দৃশ্য

‘চলুস’ শব্দটির বিকৃত কিছু উচ্চারণও শোনা যায়। যেমন শলুস কিংবা সালুস ইত্যাদি। যে নামেই ডাকা হোক না কেন তার সৌন্দর্যে কিন্তু মোটেই ভাটা পড়ে না।

এখানকার আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ এবং আর্দ্র। এখানে উৎপন্ন শস্য সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে ধান, দুগ্ধজাত পণ্য সামগ্রী এবং শস্যদানা জাতীয় বিচিত্র ফসল। চলুস নামে একটি নদীও আছে। এই নদীটির দৈর্ঘ প্রায় আশি কিলোমিটার। ত্বলেগন ও কান্দাভন থেকে সৃষ্ট এই নদীটি চলুস শহর অতিক্রম করে বয়ে গেছে সেই কাস্পিয়ান সাগর পর্যন্ত। যাবার পথে নদীটি শাখা প্রশাখা রেখে গেছে প্রচুর।

ইতিহাসবিদদের মতে চলুস শহরটি বেশ প্রাচীন। সেই সাসানী আমলের প্রথম আর্দেশিরের সময় অর্থাৎ খ্রিষ্টিয় তৃতীয় শতাব্দীতে গড়ে উঠেছিল। পার্সি পুরোণো শাসকদের জন্যে এখানে একটা প্রাসাদও নির্মাণ করা হয়েছিল। সে কারণেই নিরাপত্তার বিষয়টি চিন্তা করে শক্ত প্রাচীর দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছিল প্রাসাদসহ পুরো চলুস শহরটিকে। তবে বলা হয়ে থাকে যে চলুসের নিরাপত্তার জন্যে নির্মিত এই শক্ত প্রাচীরটি হিজরি ২৮৭ সালে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।

চলুসের প্রাকৃতিক পরিবেশ বেশ সমৃদ্ধ। মন কেড়ে নেওয়া এই প্রকৃতির নিবীড় মায়ার কারণে চলুসে প্রতি বছরই হাজার হাজার মানুষ ভ্রমণ করতে আসে। সত্যিই চমৎকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। তেহরান থেকে চলুসগামী মহাসড়ক ধরে এগিয়ে গেলে এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন যে-কেউ। তেহরান থেকে চলুসের থেকে যাবার পথে আলবোর্য পর্বতমালার বিভিন্ন পাহাড়ের কোল ঘেঁষে কিংবা কখনো পাহাড়ের বুক চিরে যেতে হয়। যেতে যেতে আরো পড়বে চলুস নদী-যেন পর্বতমালার পাথুরে উপত্যকার তালুতে সমান্তরালভাবে চলে গেছে। আবার কখনো নজরে পড়বে উঁচু উঁচু পাহাড়ের সারি একেবারে কাছে এগিয়ে আসছে যেন।

আঁকাবাঁকা সড়ক, সড়ক ধরে যাবার সময় সামনে পড়া নদীর প্রবহমানতা, অসংখ্য প্রাকৃতিক ঝর্ণা, সবুজ বন বনানী, অসংখ্য টানেল সব মিলিয়ে অন্যরকম একটা অনুভূতি আপনাকে পেয়ে বসবে। ভালো লাগবে নিঃসন্দেহে। একটা আশ্চর্যের বিষয় হলো যে পাথরের স্তর ভেদ করে বেড়ে উঠেছে যেসব বিশাল বৃক্ষ সেগুলো পাথরের অন্তর থেকে কী যে খাবার খায়ম ভাবতেই অবাক লাগে। অনেক সময় ভীতিকর এলাকাও নজরে পড়ে। হিংস্র জন্তু জানোয়ারের বাস এসব এলাকায়।

এরকম আরো বহু বিস্ময়কর সৌন্দর্য নজরে পড়বে চলুসে পৌঁছার আগেই। চমৎকার প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলি আপনার ভেতরে যে এক নতুন আমেজ সৃষ্টি করবে, সেই আমেজ বহন করেই আপনি গিয়ে উঠবেন চলুসে। চলুসে গেলে পরিচিত হবেন আরো অনেক বিস্ময়ের সাথে। একেবারে সবুজে শ্যামলে ঢাকা একটা শহর চলুস। পাশেই সমুদ্রের অনাবিল রহস্যময়তা, তরঙ্গের পর তরঙ্গের নিরন্তর কলধ্বনি, সুশীতল হাওয়ায় সেই ধ্বনির ভেসে আসা ইত্যাদি। এখানকার লোকজনও ভীষণ অতিথি পরায়ন, ভীষণ আন্তরিক। চলুস শহরে ঘুরে বেড়ানোর সময় নজরে পড়বে এখানকার স্থানীয় কিছু পণ্য। সুগন্ধি চা, সুন্দর চাল, বহু রকমের কুলুচে মানে আখরোট বা পুরযুক্ত একধরনের কেক এবং বিচিত্র ধরনের মাছ, মাছের কাবাব ইত্যাদি। ভোজন বিলাসের চমৎকার আয়োজন এখানে অহরহ।

হোটেল, পার্ক, ভিলা, সুন্দর সুন্দর সড়ক, বিনোদনের বিচিত্র আয়োজন সবমিলিয়ে চলুস ইরানের অন্যতম পর্যটক আকর্ষণীয় শহরে পরিণত হয়েছে। রাস্তাঘাটগুলো এমনভাবে সাজানো যে দুপাশের বড়ো বড়ো গাছগুলো উপরে উঠে ছাদের মতো ছায়া বিস্তার করে। বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে এখানে প্রসিদ্ধ একটি স্পট হলো ‘নামাক আবরুদ’। নামাক আবরুদে গেলে আর ফিরতে চায় না মন। এ কারণেই সারা বছর ধরে বিশেষ করে গ্রীষ্ম এবং বসন্তের সময় দেশী বিদেশী পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড় থাকে চলুসে।

নামাক আবরুদ একটি উপশহর। চলুস শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে এই উপশহরটি অবস্থিত। থাকার সুন্দর আয়োজনের পাশাপাশি এখানে আছে টেলিকেবিন। এই টেলিকেবিনে চড়ে পুরো বনাঞ্চল দেখে নেওয়া যায় সহজেই। টেলিকেবিনের উচ্চতা থেকে নীচের সমুদ্র আর সবুজ বনবনানীকে ছবির মতো সুন্দর দেখায়।

এখানে দেখার মতো আরেকটি স্থান হলো ‘চয়িখোরন প্রাসাদ’। এই প্রাসাদটি ইরানের জাতীয় ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত হয়েছে। এই স্থাপনাটি ‘প্রাসাদ অঙ্গন’ নামের একটি এলাকায় পড়েছে। চলুস সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য কর্তৃপক্ষের অধীনে ছিল কিছুকাল।

‘চয়িখোরন প্রাসাদ’ স্থাপনাটির আয়তন চার হাজার বর্গমিটারের মতো। বেইজমেন্টসহ উপরে একতলা ভবন। ভবনের পূর্ব এবং পশ্চিম দিকে রয়েছে প্রবেশ পথ। ভেতরে রয়েছে একটি হলরুমসহ আরো অনেক কক্ষ। কক্ষগুলো চক-প্লাস্টারের বিচিত্র কারুকার্যে সাজানো। প্রাসাদটির নাম থেকেই বোঝা যায় যে এটি স্বল্পকালীন বিশ্রাম নেওয়ার জন্যে বানানো হয়েছে। এখানকার পর্যটক আকর্ষণীয় আরো দুটি দর্শনীয় প্রাকৃতিক নিদর্শন হলো ‘তাখতে সোলায়মান’ পর্বতচূড়া এবং ‘এলমকূহ’ পর্বতচূড়া। তাখতে সোলায়মান চূড়াটির উচ্চতা চার হাজার আট শ পঞ্চাশ মিটার আর এলমকূহের উচ্চতা চার হাজার তিন শ পঁয়ত্রিশ মিটার। এগুলোর চূড়ায় প্রাকৃতিক হিমাগার রয়েছে। চলুস থেকে ৬০ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে এগুলো অবস্থিত। প্রতিবছরই গ্রীষ্মকালে প্রকৃতিপ্রেমীরা এবং পর্বতারোহীরা এখানে বেড়াতে আসেন।

‘কালরদাশ্‌ত’ নামে আরেকটি প্রাকৃতিক নিদর্শন আছে এখানে। চলুস থেকে ৪৫ কিলোমিটারের মতো দূরে প্রাকৃতিক এই অপূর্ব সৌন্দর্যটি বিরাজ করছে। প্রকৃতিকে ভালোবাসেন যাঁরা তাঁদের কাছে এই কালরদাশ্‌ত ‘হারানো বেহেশত’ নামে বিখ্যাত। এখানে হ্রদ আছে, প্রাকৃতিক হিমাগার আছে, আছে সবুজ শ্যামল দৃশ্যাবলি। হ্রদের নাম ‘ভেলাশ্‌ত’। এটি অবস্থিত কালরদাশতের একটি গ্রামে। হ্রদের আয়তন বিশ হেক্টরের মতো। ইরানের মিষ্টি পানির অন্তত দশটি হ্রদের মাঝে এটি অন্যতম। দৈর্ঘে এটি ৬৫০ মিটারের আর প্রস্থে ৩০০ মিটারের মতো। হ্রদটির গভীরতা ত্রিশ মিটার। পানি বেশ স্বচ্ছ। মাছ শিকার আর নৌকায় বেড়ানোর উপযোগী হ্রদটি।

কালরদাশ্‌ত চমৎকার একটি এলাকা। আবহাওয়া খুবই সহনীয়। গ্রামটির একদিকে কাস্পিয়ান সাগর আর অপরদিকে এলমকূহ পর্বতচূড়ার পাথুরে উপত্যকা। গ্রামটির চারদিকেই বাগান আর বাগান। বাগান ছাড়াও এখানে রয়েছে বেশ কটি নদী আর ঝর্ণা। সবমিলিয়ে কালরদাশ্‌ত এলাকাটি সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে নজিরবিহীন সুন্দর।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/০৬