সন্তান গ্রহণের বা ধারণের প্রাথমিক পর্যায় থেকেই বাবা-মাকে হতে হবে খুব সতর্ক
আদর্শ মানুষ গড়ার কৌশল (পর্ব-২৩)
গত পর্বে আমরা শিশু-কিশোরদের নামাজ শেখানোর পন্থা ও সংশ্লিষ্ট নানা কৌশল এবং এ সংক্রান্ত প্রধান নীতিমালা সম্পর্কে কথা বলেছি। আজ আমরা শিশুদের পবিত্র কুরআন শেখানোর বিষয়ের ওপর বিশেষ আলোকপাত করব।
বৃষ্টি যেমন মৃতভূমিকে জাগিয়ে তোলে ও সেখানে গড়ে ওঠে সবুজশ্যামল প্রান্তর, নানা ধরনের উদ্ভিদ, ফুল ও ফল এবং নদী-নালা জন্ম নেয় নানা প্রজাতির মাছ তেম্নি পবিত্র কুরআনকেও মানুষ যদি গ্রহণ করে বা মেনে নেয় তাহলে তারাও পায় এ থেকে পার্থিব ও আধ্যাত্মিক নানা খাদ্য বা কল্যাণ। পবিত্র কুরআন মানুষকে দেখিয়ে দেয় সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য এবং দেখায় সুপথ।
প্রশ্ন হল আপনার সন্তানকে কখন পবিত্র কুরআন শেখানো শুরু করবেন? কোনো কিছু শেখার ও মুখস্থ করার সবচেয়ে ভালো সময় হল শৈশব। শৈশবে মানুষের স্মৃতি-শক্তি খুবই প্রখর থাকে। পবিত্র কুরআন শেখার জন্যও তাই শৈশব সবচেয়ে ভালো সময়। মহানবী (সা) বলেছেন: যে বাবা মা তাদের সন্তানকে কুরআন শেখান কিয়ামতের দিন সেই বাবা-মায়ের মাথায় সম্রাটের মুকুট পরানো হয় এবং তাদেরকে এমন দুই বেহেশতি পোশাক পরানো হয় যে মানুষ কখনও তা দেখেনি। (ওসায়েলুশ শিয়া, চতুর্থ খণ্ড, পৃ:৮২৫)
মহানবী (সা) সন্তানকে কুরআন শেখানোর গুরুত্ব প্রসঙ্গে আরও বলেছেন, যে তার সন্তানকে কুরআন শেখাবেন তার জন্য রয়েছে দশ হাজার বার কাবা ঘর জিয়ারতের সাওয়াব, দশ হাজার বার হজ করার পুণ্য ও দশ হাজার বার ওমরাহ হজ করার সাওয়াব এবং নবী ইসমাইলের দশ হাজার সন্তানকে মুক্ত করার সাওয়াবসহ দশ হাজার বার জিহাদে অংশ নেয়ার সাওয়াব ও দশ হাজার দরিদ্র মুসলমানকে খাবার দেয়ার সাওয়াব ও দশ হাজার নগ্ন মুসলমানকে পোশাক দেয়ার সাওয়াব। এ ছাড়াও প্রতিটি অক্ষর শেখানোর জন্য দশটি সাওয়াব লেখা হয় ও দশটি গোনাহ মাফ করা হয় এবং এসবই কবরে তার সঙ্গী হয়ে থাকবে ও কবর থেকে ওঠার পর হিসাব নিকাশের সময় এসবের কারণে তার সৎকাজের পাল্লা খুবই ভারী হবে। এমন ব্যক্তি বিদ্যুতের মত পুলসিরাত পার হবেন এবং তাঁর প্রত্যাশিত সবচেয়ে বড় সম্মান ও প্রতিদান না পাওয়া পর্যন্ত কুরআন তাঁর থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না।
তাই বাবা-মায়ের উচিত সন্তানদের কুরআন শেখানোর ব্যাপারে খুবই মনোযোগী হওয়া এবং কুরআনের বানী মেনে চলা ও সন্তানরা যাতে পবিত্র কুরআনকে ভালবাসে সেই পরিবেশ সৃষ্টি করা।
কাউকে বা কোনো কিছুকে ভালোবাসতে হলে তার সঙ্গে যোগাযোগ খুব বেশি মাত্রায় রাখতে হয়। শৈশব ও কৈশোরেই পবিত্র কুরআনের অনুরাগী হতে পারাটা মহান আল্লাহর অনেক বড় নেয়ামত।
শিশুকে পবিত্র কুরআন শেখানো বলতে কেবল কিছু মন্ত্র শেখানোকে বোঝায় না যে মন্ত্রের অর্থও তার জানা থাকবে না! বরং পবিত্র কুরআন এমনভাবে শেখাতে হবে যাতে এই কুরআন থেকে সন্তানরা জীবনের নানা বিষয়ের শিক্ষা নেয় ও গঠনমূলক বা কল্যাণমূলক নানা কৌশল বা শিল্পও তারা যেন শিখতে পারে।
আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী আ বলেছেন, বাবার ওপর সন্তানের রয়েছে অধিকার ও সন্তানের ওপরও বাবার রয়েছে অধিকার। সন্তানের ওপর বাবার অধিকার হল আল্লাহর অবাধ্য হওয়ার নির্দেশ ছাড়া তার অন্য সব নির্দেশ সন্তান মেনে চলবে এবং বাবার ওপর সন্তানের অধিকার হল এটা যে পিতা সন্তানের সুন্দর নাম রাখবেন ও সন্তানকে সুশিক্ষিত করবেন আর পবিত্র কুরআন শেখাবেন। আবদুর রহমান সালামি নামের এক ব্যক্তি ইমাম হুসাইন (আ)'র এক সন্তানকে সুরা ফাতিহা শিখিয়েছিলেন। ওই শিশু তা বাবার সামনে পড়ে শোনান। ইমাম তখন ওই শিক্ষককে এক হাজার দিনার দেন যা কঠোর কৃষিকাজ করে আয় করেছিলেন ইমাম! এ ছাড়াও তাকে হীরাসহ দামী পাথরের কয়েকটি টুকরো ও ইয়েমেনের বিশেষ দামি কাপড়ের এক হাজার মিটার দেয়ার ব্যবস্থা করেন। এত ব্যাপক পুরস্কার দিতে দেখে সবাই বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলে ইমাম বলেন, এই শিক্ষককে যথাযোগ্য পুরস্কার দেয়ার মত আর্থিক পুরস্কার কি আমি দিয়েছি?। অর্থাৎ আমি যা যা দিয়েছি সুরা ফাতিহা শেখানোর মূল্য তার চেয়ে অনেক বেশি!
যেসব বাবা মা বাস্তব জীবনে কুরআনের অনুসারী নন তারা সন্তানকে সমাজের নানা বিচ্যুতি ও ক্ষতি থেকে কখনও সন্তানকে রক্ষা করতে পারবেন না। ইসলামের শিক্ষায় বলা হয় প্রথমে সন্তানকে কুরআন ও এর অর্থের প্রতি আগ্রহী করে তুলুন। খেলাধুলার প্রতি আসক্ত সাত বছরের কম বয়সের সন্তানকেও এমনভাবে কুরআন শেখান যাতে তারা আনন্দ পায়। পবিত্র কুরআনের প্রাথমিক ও সহজ কিছু নির্দেশিকা বা শিক্ষা যেমন, আল্লাহকে ভালবাসা, মিথ্যা কথা না বলা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা, জীবজন্তুকে কষ্ট না দেয়া, অপচয় না করা – এ ধরনের আরও অনেক আয়াত নানা ধরনের সংঘবদ্ধ খেলাধুলা, সরল নাটিকা ও বাস্তব কাজের মাধ্যমে শিশুদের শেখানো যেতে পারে। কুরআন শিক্ষার ক্লাসেই এসব হতে পারে ও সবশেষে এমন একটি কবিতা আবৃত্তি রাখা উচিত যার মধ্যে থাকবে কুরআনের ওই বাক্যগুলোর সরল অনুবাদ। এভাবে শিশু কুরআনের উল্লেখিত পছন্দনীয় কাজগুলো যেমন শিখতে পারবে তেমনি কুরআনের সঙ্গেও পরিচিত হয়ে উঠবে । শিশুরা গল্প শুনতে খুব ভালবাসে। তাই ঘুমানোর আগে তাদেরকে কুরআনের উল্লেখিত কাহিনীগুলো শোনানোর চেয়ে ভালো কাজ আর কি হতে পারে? এসব কাহিনীর সবই বাস্তব। খুব আকর্ষণীয়ভাবে এসব কাহিনী বর্ণনার চেষ্টা করতে হবে যাতে তাদের মন ও প্রাণ খুবই আকৃষ্ট হয়। তবে মনে রাখা দরকার শিশুদেরকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আল্লাহর রহমত ও দয়া সংক্রান্ত কাহিনীগুলো শোনাবেন শাস্তি ও আল্লাহর ক্রোধ সংক্রান্ত কাহিনীগুলো নয়।
ইরানের সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ হুসাইন আলম আল হুদা তাবাতাবায়ি মাত্র পাঁচ বছর বয়সে পবিত্র কুরআনের হাফিজ হয়েছিলেন। টেলিভিশনে কুরআনের নানা আয়াত ও সেসবের অনুরূপ আয়াত তিনি তিলাওয়াত করে শোনাতেন এবং শানে নুজুলও বলতেন! ইরান ও মুসলিম বিশ্বের নানা মিডিয়া তাকে কুরআনের বিস্ময়কর প্রতিভা বলে উল্লেখ করত। তিনি মাত্র নয় বছর বয়সে কুরআন বিষয়ে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। তার মা তাকে কর্মস্থলেরই কোনো যায়গায় যেখানে কুরআন হিফজের ক্লাস হত সেখানে নিয়ে যেতেন। তাবাতাবায়ির বয়স যখন মাত্র আড়াই বছর তখন তার বাবা দেখেন যে এই শিশু নিজে নিজে গুনগুন করে কুরআনের আয়াত পড়ছে! ফলে তিনি ধারণা করেন যে ওর মধ্যে কুরআন মুখস্থ করার প্রতিভা রয়েছে এবং মায়ের সঙ্গে কুরআন হিফজের ক্লাসে যাওয়ার কারণেই সে কুরআনের ত্রিশতম পারার কোনো কোনো আয়াত গুণগুণ করে আবৃত্তি করত। যেসব আয়াত ওই ক্লাসের শিক্ষার্থীরা শেখার পর তা মুখস্থ করে শোনাত তা শুনে শুনেই সেও ওই আয়াতগুলো মুখস্থ করে ফেলে। এ অবস্থায় তাকে নিয়মমাফিক হিফজে কুরআনের ক্লাসে ভর্তি করে হিফজের প্রশিক্ষণ দেয়া হলে ৫ বছরেই সে পুরো কুরআনের হাফিজ হয়। কেবল সময়মত পদক্ষেপ নেয়ার কারণেই এই বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হয়েছিল। কুরআন হিফজ করা ছাড়াও অসাধারণ প্রতিভাধর শিশু তাবাতাবায়ি কুরআনের আয়াতের নানা শিক্ষা বা ভাবার্থও খুব সুন্দরভাবে বলতেন। তিনি শিশু বয়সেই সৌদি আরবে আলেমদের নানা প্রশ্নের জবাব পবিত্র কুরআন থেকে দিয়ে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। বর্তমানে তিনি কুরআন বিষয়ক গবেষক হিসেবে ছাত্রদের কুরআন শিক্ষার ক্লাস নিয়ে থাকেন ও অনেক ছাত্রকে কুরআন শিখিয়েছেন। কুরআন হিফজের ক্ষেত্রে তিনি অনেক আকর্ষণীয় পন্থা ব্যবহার করে কুরআন হিফজের মাহফিলগুলোকে করেছেন বরকতময়।#
পার্সটুডে/এমএএইচ/আবুসাঈদ/ ১১
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।