দায়েশ-মুক্ত ফালুজা এবং ইরাক ও সিরিয়ার পরিস্থিতি
ইরাকের সশস্ত্র বাহিনী, শিয়া-সুন্নি স্বেচ্ছাসেবী সেনা ও উপজাতীয়দের নিয়ে গঠিত সম্মিলিত বাহিনী ১৭ জুন শুক্রবার ইরাকের আল আনবার প্রদেশের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ শহর ফালুজা মুক্ত করেছে।
তাকফিরি-ওয়াহাবি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএসআইএল বা দায়েশ ওই শহরটি দখল করেছিল ২০১৪ সালে। দায়েশ এখানে তেমন কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। এ অভিযানকে অত্যন্ত সময়োপযোগী ও এতে বেসামরিক জনগণের ক্ষয়ক্ষতিও সবচেয়ে কম হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
রামাদি ও তিকরিতের পর ফালুজাতেও দায়েশের একই পরিণতি থেকে মনে হচ্ছে ইরাকে বিদেশী মদদপুষ্ট এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর চূড়ান্ত পরাজয় অনিবার্য এবং এখন তা ঘটতেও খুব বেশী সময় লাগবে না। খুবই শিগগিরই হয়তো দায়েশ-মুক্ত হবে ইরাকের মসুল ও এমনকি গোটা সিরিয়া। সিরিয়ায় নানা অঞ্চলে দায়েশ ও আননুসরাসহ তাকফিরি-ওয়াহাবি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়ছে এবং সরকারি ও প্রতিরোধ যোদ্ধাদের হামলায় তারা বিপর্যস্ত হয়ে ও নানা অঞ্চলের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পিছু হটছে বা অনেকেই পালিয়ে যাচ্ছে সিরিয়া থেকে। বিশেষ করে ইউরোপ থেকে আসা কথিত জিহাদিরা ফিরে যাচ্ছে নিজ নিজ দেশে।
অবশ্য রামাদি, তিকরিত ও ফালুজায় দায়েশ-চক্র খুব সহজেই একেবারে পাকা ফলের মত ঝরে পড়েছে তা নয়। সন্ত্রাসীরা স্থানীয় জনগণকে মানব-ঢাল হিসেবে ব্যবহার করায় সম্মিলিত ইরাকি বাহিনীকে খুব সাবধানে ও ধীর গতিতে এগুতে হয়েছে। সরাতে হয়েছে যেখানে-সেখানে পেতে-রাখা মাইনের ফাঁদ। ফালুজার সাধারণ জনগণের অনেকেই দায়েশের অবরোধ ভেঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টার সময় এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হামলায় নিহত হয়েছে। দায়েশের সন্ত্রাসীদের হাতে অবরুদ্ধ ও পণ-বন্দী বেসামরিক নাগরিকদের যাতে কোনো ক্ষতি না হয় সেজন্য ইরাকি বাহিনী ব্যাপক সতর্কতা অবলম্বন করা সত্ত্বেও দু-পক্ষের গোলাগুলি বিনিময়ের দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনায় বেসামরিক নাগরিকদের কেউ কেউ হয়তো হতাহত হয়েছেন।
তবে স্মরণ করা যেতে পারে যে ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন হামলার সময় ফালুজা ছিল প্রতিরোধের এক বড় কেন্দ্র। তাই ফালুজা দখল করার সময় মার্কিন বাহিনী সেখানে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছিল। এ অঞ্চলে মার্কিন সেনারা ব্যবহার করেছিল নানা ধরনের নিষিদ্ধ রাসায়নিক অস্ত্র। পরবর্তীকালে ফালুজায় পাওয়া গেছে বিপুল নরকঙ্কাল।
যাই-হোক ইরাকের চলমান সন্ত্রাস-বিরোধী যুদ্ধে সরকার ও জনগণের সাফল্যে মার্কিন সরকারের ভূমিকা খুবই নগণ্য হলেও মার্কিন সরকার সব সময়ই এসব ক্ষেত্রে বড় ধরনের কৃতিত্ব দাবি করে আসছে। ইরাকে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কথিত মার্কিন বিমান হামলা ছিল অনিয়মিত ও এসব হামলায় প্রায় সব সময়ই নিহত হত নারী ও শিশুসহ বিপুল সংখ্যক নিরপরাধ বেসামরিক ইরাকি নাগরিক।
আইএসআইএল বা দায়েশের বিরুদ্ধে মার্কিন হামলা যে কেবলই লোক-দেখানো এবং আকার্যকর তা বোঝা যায় মার্কিন সরকারের প্রতি দায়েশের আচরণ থেকেই। প্রায় দুই বছর বা তারও বেশি সময় ধরে মার্কিন বিমান কথিত হামলা চালাচ্ছিল দায়েশের বিরুদ্ধে। কিন্তু এতে দায়েশ সুড়সুড়ি ছাড়া কিছুই অনুভব করেনি। দায়েশ এ নিয়ে কোনো হৈচৈও করেনি। মনে করা হয় কখন ও কোথায় মার্কিন বিমান দায়েশের ওপর হামলা চালাবে দায়েশকে তা আগেই জানানো হয়। আমেরিকা আন্তরিকভাবে চাইলে স্থানীয় জনগণের কাছে ব্যাপক মাত্রায় ঘৃণিত দায়েশ বা আইএসআইএলকে ইরাকে ও সিরিয়ায় ধ্বংস করে দেয়া মাত্র দুই মাসের মধ্যেই সম্ভব হত।
অনেক সময় কুর্দি যোদ্ধাদের সহায়তা দেয়ার নামে মার্কিন বিমান থেকে দায়েশকে অস্ত্র ও ত্রাণ সাহায্য দেয়া হয়েছে। ইরাকে মার্কিন ও পশ্চিমা বিমান থেকে প্রায়ই অস্ত্র ও রসদ-সাহায্য পেয়েছে দায়েশ। ইরাকে ও সিরিয়ায় দায়েশের সন্ত্রাসীরা ধরা পড়ার পর বা নানা স্থানে তারা পরাজিত হওয়ার পর তাদের কাছে ও তাদের গোপন আস্তানাগুলোতে প্রায়ই অতি উন্নত মানের মার্কিন ভারী অস্ত্র পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও পাওয়া গেছে সৌদি, তুর্কি, কাতারি রসদ বা খাদ্য সামগ্রী।
অন্যদিকে রাশিয়া যখন সিরিয়ায় সন্ত্রাসীদের অবস্থানে ব্যাপক ও কার্যকর হামলা চালাতে থাকে তখন দায়েশ নিজেই ঘোষণা দেয় যে তাদের ষাট শতাংশ শক্তি ও অস্ত্র ধ্বংস হয়ে গেছে। হায় হায় করতে থাকে মার্কিন, তুর্কি ও কয়েকটি আরব সরকার। তারা দাবি করে যে রাশিয়া সিরিয়ায় কথিত মধ্যপন্থী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর ওপরও হামলা চালাচ্ছে। মার্কিন, তুর্কি ও সৌদি সরকার সিরিয়ায় আলকায়দা ও আইএসআইএল-এর নতুন সংস্করণ আননুসরাকে মধ্যপন্থী বলে দাবি করে থাকে। অথচ এই আননুসরা ও দায়েশ বা আইএসআইএল মূলত অভিন্ন বা নতুন বোতলে সেই পুরণো মদ মাত্র!
সিরিয়ায় রুশ বিমান হামলায় দায়েশের কথিত খিলাফত লন্ডভন্ড হয়ে পড়ায় মার্কিন সরকারসহ তাদের মদদদাতা গডফাদাররা ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে। মনে করা হয় এ জন্যই প্রতিশোধ নিতে মিশরে রাশিয়ার যাত্রীবাহী বিমান ভূপাতিত করে দায়েশ। আর ওই বিমান ভূপাতিত করার অস্ত্রও দিয়েছে খোদ মার্কিন সরকার। জর্জ গ্যালাওয়ের মত প্রখ্যাত বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকরা এই মত প্রকাশ করেছেন।
আল-কায়দার নতুন সংস্করণ হিসেবে আইএসআইএল বা দায়েশকে সর্বাত্মক সহায়তা দিয়ে গড়ে তুলেছে খোদ মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা। এ গোষ্ঠীকে মদদ দেয়ার ক্ষেত্রেও সৌদি, কাতারি ও তুর্কি সরকারের ওপর নির্ভর করেছে মার্কিন সরকার। গোটা মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে শিয়া-সুন্নি সংঘাত ছড়িয়ে দেয়ার কাজে আইএসআইএল বা দায়েশকে ব্যবহার করেছে ইহুদিবাদী ইসরাইল ও মার্কিন সরকার। ইরাককে টুকরো টুকরো করার জন্য এখনও মার্কিন সরকার ও তার তাবেদার আঞ্চলিক সরকারগুলো ইরাকে সাম্প্রদায়িক ও মাজহাবি বিভাজনকে উৎসাহ দিচ্ছে।
কথিত সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলার মার্কিন নীতি নানা ধরনের দ্বিমুখী আচরণের কারণে কখনও বিশ্বাসযোগ্যতা ও আস্থা অর্জন করেনি। সিরিয়ায় সন্ত্রাসীদের মধ্যে কথিত ‘নমনীয়’ বা মধ্যপন্থী সন্ত্রাসী আবিষ্কার করে তাদের সহায়তা দিচ্ছে মার্কিন সরকার। অথচ ইরাকে সক্রিয় একই সন্ত্রাসীদের উগ্র বলে অভিহিত করছে মার্কিন সরকার।
সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ইরাকি জনগণের মধ্যে যে ঐক্য রয়েছে তাকে ভালোভাবেই কাজে লাগাচ্ছে ইরাকের বর্তমান সরকার। ইরাকের শিয়া, সুন্নি ও কুর্দিরা অতীতের মতই এক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। তারা অন্য সব ক্ষেত্রেও ঐক্য বজায় রেখে ইরাকের স্বাধীনতা ও অখণ্ডতা রক্ষা করবে বলে আশা করা যায়। তাকফিরি সন্ত্রাসীদের উত্থানের পর এ অঞ্চলে কেবল ইহুদিবাদী ইসরাইল ও তার পশ্চিমা সহযোগীরাই লাভবান হয়েছে অস্ত্র-ব্যবসাসহ নানা দিক থেকে।
ইরাক ও সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যে এবং গোটা মুসলিম বিশ্বে ডিভাইড এন্ড রুল তথা ‘ভাগ করে শাসন কর’ শীর্ষক নীতি চালু করেছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। মার্কিন সরকারও সেই একই নীতি অনুসরণ করছে ভিন্ন আঙ্গিকে। ইরাকে রাজনৈতিক সংকট ও নিরাপত্তাহীনতার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে মার্কিন মদদপুষ্ট বাথিস্ট বা সাদ্দামপন্থীদের দৌরাত্ম। মূলত এরাই সৌদি অর্থে, মার্কিন অস্ত্রে ও ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থার উৎসাহে ইরাকে আল-কায়দার পর গড়ে তুলেছে আইএসআইএল তথা দায়েশ।
ইরাকের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে সক্রিয় শিয়া মুসলিম রাজনৈতিক দলগুলোর অনভিজ্ঞতা ও অনৈক্যের সুযোগ নিয়ে সুন্নি অধিকার রক্ষার অজুহাতে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার নামে ময়দানে নামানো হয় আল-কায়দার নতুন সংস্করণ আইএসআইএল বা দায়েশকে। মার্কিন সরকার ও সৌদি সরকারের মদদ ছাড়া তারা ইরাকে কথিত খেলাফত প্রতিষ্ঠার সাহস করত না। কুর্দিস্তানের সঙ্গে ইরাকের কেন্দ্রীয় সরকারের বিরোধের সুযোগ নিয়ে এবং ইরাকি সশস্ত্র বাহিনীর একদল কমান্ডারের উদাসীনতা বা বিশ্বাসঘাতকতার প্রেক্ষাপটে দায়েশ ২০১৪ সালে দখল করে বসে ইরাকের বৃহত্তম শহর মসুল।
এদিকে সিরিয়া ও ইয়েমেনের মত ইরাকেও প্রকাশ্য হস্তক্ষেপ অব্যাহত রেখেছে সৌদি সরকার। বাগদাদে নিযুক্ত সৌদি রাষ্ট্রদূত মাঝে মধ্যেই ইরাকের সরকার, ইরান ও স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীর বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক নানা বক্তব্য আর অপবাদ উগড়ে দিয়ে বেশ বিতর্কিত হয়েছেন। ইরাকের অনেক রাজনীতিবিদ তাকে বহিষ্কারের দাবি জানিয়েছেন। ইরাক সরকারের কর্মকর্তারাও দেশটির ঘরোয়া বিষয়ে নাক গলানোর জন্য সৌদি রাষ্ট্রদূতের নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, এই ব্যক্তি ইরাকে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব উসকে দিতে চান। সৌদি সরকার ইরাকের শিয়া, সুন্নি ও কুর্দিদের ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। ইরাকের নানা অঞ্চল দায়েশের হাত থেকে মুক্ত হওয়ায় খুশি নয় সৌদি সরকার।
সম্প্রতি দায়েশকে দমনে ব্যস্ত ইরাকের কেন্দ্রীয় সরকারকে আবারও উদ্বিগ্ন করার মত কথা বলেছেন, স্বায়ত্তশাসিত ইরাকি কুর্দিস্তানের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা মাসরুর বারাজানি। মাসুদ বারাজানির ছেলে মাসরুর বারাজানি কুর্দিস্তানের নিরাপত্তা পরিষদের প্রধান। তিনি সম্প্রতি বলেছেন, ইরাকে তাকফিরি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দায়েশকে পরাজিত করার পর সেখানে তিনটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে হবে। শিয়া, সুন্নি ও কুর্দিদের জন্য গঠিত হবে এই পৃথক তিন রাষ্ট্র। তিনি বলেছেন, ইরাকের ফেডারেশন ব্যবস্থায় কাজ হচ্ছে না। তাই এখানে হয় কনফেডারেশন অথবা পুরোপুরি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কনফেডারেশন গঠন করা হলে তিনটি সমান ক্ষমতার রাজধানী গঠনও সম্ভব হবে এবং এর ফলে কেউ কারো ওপরে থাকবে না বলে তিনি মন্তব্য করেন।
বারাজানি এর আগেও এ ধরনের দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু বাগদাদ কঠোরভাবে এই দাবির বিরোধিতা করেছে। ইরাকি কুর্দিস্তান সরকারের সঙ্গে ইসরাইলের খুব ঘনিষ্ঠ বাণিজ্য, সামরিক ও গোয়েন্দা সহযোগিতার সম্পর্ক রয়েছে। বাগদাদের বিরোধিতা সত্ত্বেও তুরস্কের মাধ্যমে ইসরাইলে তেল বিক্রি করছে কুর্দিস্তান।
এটা স্পষ্ট এ অঞ্চলের মুসলিম দেশগুলোকে যত বেশি বিভক্ত করা যাবে ততই লাভবান হবে ইসরাইল ও মার্কিন সরকার।#
পার্সটুডে/মু.আ.হুসাইন/২৯