মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি- ৬৯: ইসলামে খাজনার ইতিহাস
পবিত্র কোরানের সুরা মু'মেনুনের ৭২ নম্বর আয়াতে আরবি খারাজ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। এ আয়াতে শব্দটিকে পারিশ্রমিক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ফসলের মাঠ থেকে উতপাদিত পণ্যের ওপর নির্ধারিত খাজনাকে খারাজ হিসেবে উল্লেখ করা হতো। প্রথম থেকে ষষ্ঠ হিজরি পর্যন্ত মুসলিম ভূখণ্ডের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আয়ের উত্স ছিল 'খারাজ'।
ইসলামের প্রাথমিক যুগে নতুন নতুন ভূখণ্ড ইসলামী শাসনের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে মুসলিম সরকারের জন্য শক্তিশালী অর্থনৈতিক অবকাঠামো নির্মাণের প্রয়োজন দেখা দেয়। এ সময় বিশাল মুসলিম সাম্রাজ্য পরিচালনার জন্য খলিফাদের বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এ ছাড়া, নতুন নতুন প্রদেশ স্থাপিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব প্রদেশের নিরাপত্তা রক্ষার স্বার্থে সেনাবাহিনী গঠন করা হয়। বিশাল এ সৈন্যবাহিনীর ভরণ-পোষণের জন্য খলিফারা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সমৃদ্ধ হওয়ার দিকে মনযোগী হন।
আমরা আগেই উল্লেখ করেছি পবিত্র কোরানে পারিশ্রমিকের প্রতিশব্দ হিসেবে খারাজ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। ধারণা করা যায়, মুসলমানরা ইরান অধিগ্রহণ করার পর ইরানিদের কাছ থেকে খারাজ সংগ্রহের পদ্ধতি পাকাপোক্তভাবে শিখেছিল। ফসলের জমিতে কৃষিকাজের মাধ্যমে উত্পাদিত পণ্যের ওপর যে খাজনা বসানো হতো, তারই নাম ছিল খারাজ। ওদিকে মক্কায় আল্লাহর ঘর কাবা'র অবস্থানের কারণে ঐতিহাসিকভাবে সেখানে একটি নগর সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। কাজেই মক্কাকে কেন্দ্র করে একটি ব্যবসায়ী শ্রেণী গড়ে উঠেছিল এবং মক্কা নগরী হয়ে উঠেছিল বণিকদের জন্য কেনা-বেচার একটি উপযুক্ত স্থান। বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মাদ (সা:)-এর নেতৃত্ব একটি ফেডারেল শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পর কৃষিপণ্যের ওপর খাজনা বা খারাজ বসানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এখানে বলে রাখা ভালো যে, ইসলামের আবির্ভাবের আগে কখনো রাষ্ট্রীয়ভাবে খারাজ সংগ্রহের প্রচলন ছিল না।
আরব ভূখণ্ডে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইরান জয় করার আগ পর্যন্ত খারাজ পদ্ধতি ছিল অনেকটা এরকম- একটি কৃষিজমিতে উত্পাদিত পণ্যের অর্ধেক পেত রাষ্ট্র এবং বাকি অর্ধেক ফসল উদপানকারী কৃষককে দেয়া হতো। রাসূলুল্লাহ (সা:) মুসলিম ভূখণ্ডের উর্বর ভূমিগুলোর জন্য এ পদ্ধতি চালু করেন। ইসলামের প্রাথমিক যুগের প্রখ্যাত ফকীহগণ এ ধরনের জমিকে রাষ্ট্রের সম্পদ বলে অভিহিত করেন। উল্লেখ করা যেতে পারে, ইসলামী রাষ্ট্রের অর্জিত সম্পদকে এ সময়ে দু'ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। একটি অভ্যন্তরীণ আয় যা আসতো খারাজ থেকে এবং দ্বিতীয়টি ছিল বাহ্যিক বা বৈদেশিক আয় যা আসতো নতুন নতুন ভূখণ্ড জয় করার পর গণিমত হিসেবে।
তবে নতুন ভূখণ্ড জয় হতে হতে গণিমতের সম্পদ এত বেশি আসতে থাকে যে তা অভ্যন্তরীণ সম্পদের চেয়ে অনেক গুণ বেশি হয়ে যায়। ফলে খারাজের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ এবং নগরকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে অর্জিত অর্থ- গণিমতের সম্পদের নীচে চাপা পড়ে যায়। এরপর মুসলিম ভূখণ্ডে বসবাসরত অমুসলিমরা নিরাপদে বসবাস করার স্বার্থে যে আয়কর রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিতে শুরু করলো তার নাম দেয়া হলো জিজিয়া কর। সেই সঙ্গে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তাদের লভ্যাংশের শতকরা ১০ ভাগ হারে আয়কর গ্রহণ শুরু হলো যার নাম ছিল উশরিয়াহ। ইসলামী শাসনামলে এগুলো ছিল রাষ্ট্রীয় আয়ের প্রধান কয়েকটি উত্স।
আমরা আগেই বলেছি, তৃতীয় খলিফার শাসনামলে ইরান জয় করার পর মুসলমানরা সম্পদ অর্জনের খারাজ পদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত হয়। খেলাফতের পক্ষ থেকে বিশাল এ সম্পদ ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে সবার আগে তিনি ইসলামী আইনের আওতায় এটিকে হালাল করার দিকে মনযোগী হন। কারণ, তখনকার যুগে আরব ভূখণ্ডের বেশিরভাগ মানুষ কৃষিকাজের সঙ্গে পরিচিত ছিল না এবং এ কারণে অনেক উর্বর জমি পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। এভাবে পরিত্যক্ত থাকার কারণে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এসব জমির কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তৃতীয় খলিফা হযরত ওসমান এ সমস্যার সমাধানের জন্য সাহাবীদের পাশাপাশি গোত্র প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে এসব কৃষিজমিতে আবাদ করার সিদ্ধান্ত হয় এবং আবাদি জমি থেকে বিপুল অঙ্কের খারাজ অর্জিত হতে থাকে।
কৃষিজমিতে উতপাদিত পণ্যের ওপর খাজনা বা খারাজ আদায় একটি জটিল প্রক্রিয়া হলেও একইসঙ্গে এটি ছিল মুসলিম শাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এর মাধ্যমে খলিফারা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় কাজের পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন। যেমন, কৃষিপণ্যের ওপর খাজনা আদায় করার জন্য ফসল ঘরে ওঠার নির্দিষ্ট সময়ের ওপর নির্ভর করতে হতো। আগের একটি আসরে আমরা বলেছি, মুসলিম শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্র পরিচালনার সুবিধার্থে বর্ষপঞ্জি বা ক্যালেন্ডারের প্রচলন ঘটানো হয়েছিল। কিন্তু হিজরি সাল চাঁদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার কারণে প্রতি বছর বর্তমানের সৌরবছরের চেয়ে ১০ বা ১১ দিন করে কমে যেত। এর ফলে আরবি মাস অনুযায়ী খারাজ আদায় করতে গিয়ে দেখা গেল, এখনো ফসল কৃষকের ঘরেই ওঠেনি। এ বিষয়টি কৃষকদের জন্য মহাসমস্যা হয়ে দেখা দিল। এ সমস্যা সমাধানের জন্য দেখা দিল এমন এক পদ্ধতি উদ্ভাবনের যার ফলে খারাজ আদায়ে কোন সমস্যা হবে না। এ প্রয়োজনীয়তা থেকে সময় গণনার জন্য একটি ভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার শুরু হলো যার নাম দেয়া হলো খারাজি।
ধীরে ধীরে মুসলিম সাম্রাজ্য বিস্তৃত হওয়ার ফলে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও জটিলতর হতে থাকে। এ কারণে খারাজ পদ্ধতিতে খাজনা আদায় অনেকটা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে উদ্ভাবিত হয় নতুন পন্থার যার নাম দেয়া হয় ইক্তাহ। তবে গোঁড়ার দিকে ইক্তাহ ও খারাজ একইসঙ্গে চলতে থাকে এবং ধীরে ধীরে ইকতাহ'কে খারাজের স্থলাভিষিক্ত করা হয়। খারাজ পদ্ধতিতে রাষ্ট্র কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি খাজনা আদায় করতো। কিন্তু ইকতাহ পদ্ধতিতে বহু কৃষকের খাজনা আদায়ের জন্য এক বা একাধিক ব্যক্তিকে নিয়োগ দেয়া হলো। রাষ্ট্র এক বা একাধিক বছরের জন্য এসব কৃষিজমি নির্দিষ্ট ব্যক্তির হাতে তুলে দিত। ওই ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য রাষ্ট্রীয় কোষাগারে খাজনা জমা দিত। কালক্রমে মুসলিম ভূখণ্ডের প্রত্যন্ত এলাকায় খারাজ পদ্ধতির বদলে ইকতাহ চালু হয়ে যায়। ওসমানীয় সাম্রাজ্যের পুরোটা জুড়ে এবং ইরানে সাফাভি আমলের শেষদিকে ও কাজার শাসনামলে ইকতাহ পদ্ধতিতে খাজনা আদায় করা হতো।
মুসলিম সাম্রাজ্যে খারাজ পদ্ধতিকে একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার আওতায় আনার জন্য একটি সচিবালয় গঠন করা হয় যার নাম দেয়া হয় দিওয়ানে খারাজ। পাশাপাশি সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে আরবি ভাষার ওপর খারাজ ব্যাপক প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়। অনেক মুসলিম আলেম বিশেষ করে শিয়া আলেমগণ খারাজের ওপর বহু গবেষণামূলক কাজ করেন। এ সম্পর্কে সবচেয়ে পুরনো যে গবেষণামূলক গ্রন্থটি পাওয়া যায় তার লেখক ছিলেন আবু ইউসুফ ইয়াকুব বিন ইব্রাহিম বিন হাবিব কুফি। হিজরি ১৮২ সনে তার গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া শিয়া আলেমদের মধ্যে সর্বপ্রথম খারাজের ওপর বই লেখেনে আবু জাফর কাদামাহ বিন জাফর। তার বইটি ৩২০ হিজরিতে প্রকাশিত হয়। সেইসঙ্গে মোকাদ্দেস আরদাবিলি ও মোহাক্কেক কারাকিও খারাজ বিষয়ে গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখেছেন। এ থেকে বোঝা যায়, শিয়া ফকীহগণ সাধারণ মুসলিম জনগোষ্ঠীর সমস্যা সমাধানে বিশেষ করে খারাজ বিষয়ে ব্যাপক সচেষ্ট ছিলেন।#
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবু সাঈদ/ ১৮