ডিসেম্বর ০৬, ২০২২ ১৯:৪০ Asia/Dhaka

ভিটামিন ডি শরীরের জন্য খুবই জরুরি। ভিটামিন ডি এর অভাবে বেশকিছু জটিল রোগের পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ রোগও হতে পারে। সূর্যের আলো একটা সুনির্দিষ্ট সময়ে গায়ে লাগাতে হবে। সামুদ্রিক মাছ খেতে হবে। তাহলে ভিটামিন ডি এর অভাব পূরণ করা সম্ভব।

রেডিও তেহরানের স্বাস্থ্যকথার আসরে গুরুত্বপূর্ণ এসব কথা বলেছেন অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম।

পুরো সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো।

এটি গ্রহণ, উপস্থাপনা ও প্রযোজনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।

শ্রোতা/পাঠকবন্ধুরা! কেমন আছেন আপনারা। নিশ্চয়ই ভালো আছেন। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ক সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান স্বাস্থ্যকথার আসরে সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি আমি গাজী আবদুর রশীদ। আজ থেকে আমরা কয়েক পর্বে নতুন বিষয় ভিটামিন ডি এর স্বল্পতায় যেসব রোগ্যব্যাধী হয় তা এবং করণীয় নিয়ে কথা বলব। আর এ বিষয়ে কথা বলার জন্য আমাদের সঙ্গে অতিথি হিসেবে আছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় বা বিএসএমএমইউ এর এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ এর সহযোগী অধ্যাপাক ডা.শাহজাদা সেলিম। বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক টেক্সিলা আমেরিকান ইউনিভার্সিটি এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের অধ্যাপক।

ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার

সাক্ষাৎকারে যাওয়ার আগে ভিটামিন ডি সম্পর্কে দুটো কথা বলে রাখি। মানুষের শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর উপাদানের মধ্যে অন্যতম হলো ভিটামিন 'ডি'। ভিটামিন 'ডি' অস্থি ও দাঁতের কাঠামো গঠন করে। অন্ত্রে ক্যালসিয়ামের শোষণ বাড়ায়, রক্ত প্রবাহে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। ভিটামিন ডি মানবদেহের জন্য অত্যন্ত জরুরি। এর অভাবে নানাধরণের রোগ হতে পারে এবং তা কখনও কখনও ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। তো চলুন ভিটামিন ডি ঘাটতি সম্পর্কিত  দ্বিতীয় পর্বের আলোচনায় যাওয়া যাক।

অধ্যাপক ডা.শাহজাদা সেলিম, রেডিও তেহরানের স্বাস্থ্যকথার আসরে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।

রেডিও তেহরান: অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম, প্রথম পর্বের শেষ প্রশ্ন ছিল কেন ভিটামিন ডি এর অভাব হয়। আপনি এ সম্পর্কিত আলোচনা শেষ করতে পারেননি সময়ের স্বল্পতার কারণে। তো আপনি আজকের আসরের শুরুতে এ বিষয়ে বলুন

টোনা ফিস

অধ্যাপক ডা.শাহজাদা সেলিম:  খাদ্যের প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলছিলাম। বাংলাদেশে আমরা যেভাবে খাদ্য গ্রহণ করি তাতে ভিটামিন ডি পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ এটি চর্বিতে দ্রবীভূত। আর যে মাছ সামুদ্রিক সেখানে ভিটামিন ডি পাওয়ার সম্ভাবনা  বেশি। সবচেয়ে বেশি ভিটামিন ডি যেসব মাছ থেকে পেতে পারি- সামন্ড ফিস ও টোনা ফিস থেকে। আর বাংলাদেশের সাধারণ যেসব মাছ তা থেকে কিন্তু ভিটামিন ডি আমরা পাই না। এভাবে অনেক দেশেই কিন্তু এভাবে মাছ থেকে ভিটামিন ডি পাওয়া যাচ্ছে না। বিশেষ করে মিঠা পানির মাঝে কিন্তু ভিটামিন ডি পাওয়া যাচেছ না।

স্যামন ফিস

আর সূর্যের আলোর যে বিষয়টি বিশেষ করে উত্তর মেরুতে সূর্যের আলো এমনভাবে পড়ে যে তা মানুষের গায়ে লাগে না। ঐসব এলাকার মানুষের কিন্তু ভিটামিন ডি'র তীব্র ঘাটতি রয়েছে।

আবার ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে সূর্যের আলোর তীব্রতা খুব বেশি পরিমাণে। ফলে ঐ সব অঞ্চলের মানুষেরা কিন্তু তীব্র সূর্যের আলোতে যেতে পারেন না।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যেটি হচ্ছে যে, এখানে সূর্যের আলোর তীব্রতা তেমন নেই। মানুষ রোদে যান কিন্তু ভিটামিন ডি সেভাবে পাচ্ছে না। কয়েকদিন আগে সরকারের পক্ষ থেকে সারাদেশের মানুষের ভিটামিন ডি নিয়ে একটি গবেষণা হয়েছ। তার  রিপোর্টে দেখা গেছে প্রায় ৭০ ভাগ মানুষের ভিটামিন ডি ঘাটতি রয়েছে।

এখানে যেটি হতে পারে, সেটি হচ্ছে- আমাদের ত্বকের নিচে চর্বির যে উপাদান  থেকে ভিটামিন ডি তৈরি হয় সেখানে ভিটামিন ডি তৈরি হওয়ার সুযোগ কম এমনটি হতে পারে।

দেখুন, আমরা একটা গবেষণা করতে চাচ্ছি-যদিও এখন কাজ শুরু হয়নি। গবেষণার জন্য অর্থ যোগানের কাজ চলছে। সেটি হচ্ছে আমাদের দেশে যে সূর্যের আলো পড়ে তাতে আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি কতটুকু ? তাছাড়া এ এলাকায় আবার পরিবেশ দূষণের মাত্রা অনেক বেশি। এই দূষণের দ্বারা আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মিকে প্রভাবিত করতে পারে  কি না? কোন সময়ে আমরা রোদে গেলে কতটুক আল্ট্রাভায়োলেট রে তৈরি হতে পারে- তা নিয়ে বাংলাদেশে কোনো গবেষণা আজও হয়নি। তো গবেষণার ফলাফল যাইহোক- বাংলাদেশের মানুষের শরীরে ব্যাপক ভিটামিন ডি ঘাটতি রয়েছে। আর এই ঘাটতি কিন্তু খাবার খেয়ে পূরণ করা সম্ভব হচেছ না। সেজন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ যে কাজটি করেছে- তা হচ্ছে নির্দিষ্ট ধরণের খাবার বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ মানুষ-বৃদ্ধ, কম বয়সী, যারা ঘরের মধ্যে কাজ করে। যেমন ধরুন অনেক মানুষ জেলখানায় রয়েছেন। তাদের প্রাতিষ্ঠানিক একটি কাঠামোর মধ্যে থাকতে হচ্ছে। তারা যেসব খাবার খায় সেটি ভিটামিন ডি দিয়ে ফোরটিফাইড করে দেয়া হয়। এ থেকে পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি তারা পেয়ে থাকেন।

রেডিও তেহরান: আচ্ছা অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম, আচ্ছা আমরা সাধারণভাবে শুনে থাকি ভিটামিন ডি পাওয়ার জন্য দুপুর কিংবা বিকেল নয় সকালের দিকের সূর্যের আলো গায়ে লাগাতে বলা হয়-এটা কেন?

সূর্যের আরো ভিটামিন ডি  এর অন্যতম উৎস

অধ্যাপক ডা.শাহজাদা সেলিম: এর হিসাবটি এরকম যে, সূর্য যে আলোটি বিকিরণ করছে-সেই আলোটি যার উপর পড়বে তার সাথে যদি ৪৫ ডিগ্রির কাছাকাছি কৌণিক দূরত্ব থাকে তাহলে সেই আলোতে আল্ট্রাভায়োলেট রে পাওয়া যাবে। বিষয়টি আরেকটু সুর্নিদিষ্ট করে বলি। আল্ট্রাভায়োলেট রে'র  ২৮৫ থেকে ৩১৫ ন্যানোমিটার (Nanometer- ন্যানোমিটার হলো মেট্রিক পদ্ধতিতে দৈর্ঘ্যের একটি একক, যা হলো এক মিটারের একশো কোটি ভাগের এক ভাগের সমান (১০−৯ মি.) বা এক মিলিমিটারের এক মিলিয়ন ভাগের এক ভাগ ) ওয়েব লেংথ থাকতে হবে। ঐ আলোটা যখন ৪৫ ডিগ্রির কাছাকাছি সূর্যের সাথে ঐ ব্যক্তির কৌণিক দূরত্ব থাকতে হবে। তখনই ভিটামিন ডি পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আর সেই হিসাবে বেশিরভাগ যে মত সেটি হচ্ছে- সকাল দশটা থেকে বিকাল তিনটার মধ্যে সূর্যের যে আলোটা আসে সেই আলো থেকে আমরা ভিটামিন ডি পেতে পারি। তাহলে শীতের সময় আমরা যে খুব সকালে যে রোদ পোহাই তাতে ভিটামিন ডি পাব না। বিকাল বেলাতেও খুব মিঠা মিঠা রোদ থাকে তাতেও পাওয়া যাবে না। তাহলে দুপুরের কাছাকাছি সময়টা কিন্তু ভিটামিন ডি পাওয়ার মোটিমুটিভাবে উপযুক্ত সময়। এর আগে কিংবা পরের সময়টা ভালো। তবে গরমকালে এই সময়টা আবার রোদে যাওয়াটা কষ্টকর কারণ রোদের তীব্রতা আবার অনেক বেশি থাকে।

ভিটামিন ডি এর ঘাটতি ও করণীয় সম্পর্কে এন্ডোক্রাইনোলজি বিশেষজ্ঞ ডা. শাহজাদা সেলিমের সাক্ষাৎকার শুনছেন। ফিরছি খুব শিগগিরি। আমাদের সাথেই থাকুন।

রেডিও তেহরান: মিউজিক বিরতির পর আবারও ফিরে এলাম স্বাস্থ্যকথার আলোচনায়। ডা. শাহজাদা সেলিম- আমরা একটা বিষয় দেখে থাকি যে কোনো নবজাতক বাচ্চাকে হলুদ রংয়ের আলোর নিচে রাখা হয়-অথবা সূর্যের তাপে রাখা হয় কেন-এটা কি ভিটামিন ডি এর কারণে রাখা হয় নাকি অন্য কিছু?

অধ্যাপক ডা.শাহজাদা সেলিম: না, এটা ভিটামিন ডি এর জন্য না। এখানে শরীরে যে বিলোরোবিনটা জমা হয়-যে কারণে শরীরটা হলুদাভ হয়ে যায় সেটাকে বের করে দেয়ার জন্য ফটোসিনথেসিসের প্রয়োজন হয়। সেজন্য হয় সূর্যের আলোতে অথবা এখন হাসপাতালে নবজাতক ওয়ার্ডগুলোতে কিন্তু আর্টিফিসিয়ালি কাজটি করা হয়। এটি খুব সহজ এবং কার্যকরী বিষয়।

রেডিও তেহরান: অধ্যাপক ডা. শাহাজাদা সেলিম- আপনি ভিটামিন ডি কি, কেন ভিটামিন ডি এর ঘাটতি হয় সে সম্পর্কে বললেন খুব সুন্দর করে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে  ভিটামিন ডি এর যে অভাব  আছে সেটা আমরা কি করে বুঝব? সাধারণ মানুষ আপনাদের কাছে না যাওয়া পর্যন্ত বাইরে থেকে সে বুঝতে পারবে যে তার ভিটামিন ডি এর অভাব রয়েছে?

অধ্যাপক ডা.শাহজাদা সেলিম: হ্যাঁ আপনি ঠিকই বলেছেন- এটি একটি জটিল বিষয়। কারণ আমরা যখন কোনো কিছু খাই  তারপর সেটি কাজ করে। তবে কতদ্রুত কাজ করে তার উপর নির্ভর করে তার অভাবের লক্ষণ কত দ্রুত দেখা দেবে।

ভিটামিন ডি এর অভাবে রিকেট রোগ হয়

ভিটামিন ডি খুব ধীরে ধীরে কাজ করে। এরফলে যখন ঘাটতি হতে থাকে তখন  খুব দ্রুত লক্ষণ দেখা যায় না। ভিটামিন ডি এর ঘাটতির লক্ষণগুলো অনেক পরে দেখা যায়। বরং যে বিষয়টি ঘটে ভিটামিন ডি এর ঘাটতিজনিত কারণে পরবর্তীতে যে সমস্যাটি তৈরি হবে সেটি নিয়েই রোগী কোনো চিকিৎসকের কাছে গেলেন। যেমন ডায়াবেটিস হওয়ার পর আপনি চিকিৎসকের কাছে গেলেন-তখন পরীক্ষা করে দেখা গেল ভিটামিন ডি এর অনেক ঘাটতি রয়েছে।

অসটিওমেলাসিয়া

আগে ভিটামিন ডি এর অভাবে 'রিকেট' rickets, অসটিওমেলাসিয়া (Osteomalacia) Osteomalacia is softening of the bones.) হতো। রিকেট কম বয়সে হয় এবং অসটিওমেলাসিয়া বেশি বয়সে হয়। এই রোগগুলোর সংখ্যা একেবারে কমে গেছে। আমি প্রায় ৩৫ বছর ধরে চিকিৎসা পেশায় জড়িত। আমার ছাত্রাবস্থায় দু চারটা এসব রোগের রোগী দেখেছি।তারপর কিন্তু আর এসব রোগের রোগী দেখি না। 

তো অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম- ভিটামিন ডি এর ঘাটতি নিয়ে সৃষ্ট রোগ সম্পর্কিত আলোচনার দ্বিতীয় পর্বে রেডিও তেহরানকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে আবারও অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম: আপনাকেও ধন্যবাদ।#

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/৬

ট্যাগ