দেখব ঘুরে ইরান এবার: রমসারের হৃদয় জড়ানো প্রাকৃতিক দৃশ্য
সারি থেকে কাস্পিয়ানের দক্ষিণ উপকূল ধরে পশ্চিম দিকে গেলেই দেখা যাবে চমৎকার এবং দীর্ঘ সড়ক। সড়কের দুপাশ জুড়ে সবুজ গাছপালা আর বন বনানী।
এরকম জঙ্গলাকীর্ণ পথ বেয়ে কখনো স্বচ্ছ পানির প্রবাহমান নদীর ওপর গড়ে তোলা সেতু পেরিয়ে, কখনোবা মযান্দারন সমুদ্রের দক্ষিণ তীর ধরে সামনে এগিয়ে গেলে পড়বে আমাদের কাঙ্ক্ষিত শহর রমসার। মযান্দারন সমুদ্রের বিস্তীর্ণ তীর জুড়ে যে বনবনানী, তাকে উপর থেকে দেখলে মনে হয় সবুজ পান্নার মতো। আর উপকূল জুড়ে গড়ে ওঠা রমসার শহরটিকে মনে হয় সমুদ্রের আঁচলে নকশা করা মূল্যবান পাথরের মতো। এখানে সমুদ্র আর পাহাড়ের মাঝে দূরত্ব খুবই কম। এ কারণে মযান্দারন সাগরের দক্ষিণ অঞ্চলটির সৌন্দর্য ও চমৎকৃতি বিশেষ করে প্রাকৃতিক দৃশ্য এতো সুন্দর যে দেখামাত্রই হৃদয় জুড়িয়ে যায়। এ কারণেই হয়তো ময়ান্দারনের সবচেয়ে সুন্দর শহর হিসেবে মনে করা হয় এই রমসারকে।
রমসার শহরটি মযান্দারন প্রদেশের সবচেয়ে পশ্চিম দিকে পড়েছে। এই শহরটির উত্তরদিকে কাস্পিয়ান সাগর। দক্ষিণ দিকে আলবোর্য পর্বতমালা। পশ্চিম দিকে গিলান প্রদেশের রুদসার উপশহর আর পূর্বদিকে রয়েছে তাঙ্কাবন উপশহর। রমসার শহরটিকে প্রাকৃতিক দিক থেকে দুটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। এক অংশ পড়েছে পার্বত্য এলাকায় তাই এ অংশ বেশ উঁচু। অপর অংশটি পড়েছে পাহাড়ের পাদদেশীয় সমতল ভূমিতে, সুতরাং এই অংশটি নীচু। উঁচূ অর্থাৎ পার্বত্য এলাকাটিতে পড়েছে আলবোর্য পর্বতমালার অনেক পাহাড়। এই পাহাড়গুলো সবুজ জঙ্গলে ঢাকা। এখানে আরো আছে বহু চারণভূমি। অপরদিকে পার্বত্য পাদদেশীয় সমতলভূমিতে আছে বহু নদী। এই নদীগুলোর সবই গিয়ে মিলেছে কাস্পিয়ান সাগরের সাথে।

রমসারের আবহাওয়া বেশ নাতিশীতোষ্ণ। এমনিতেই এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হৃদয় কেড়ে নেওয়ার মতো সুন্দর। তদুপরি এখানকার মানুষগুলো অসম্ভব অতিথি পরায়ন, ভদ্র, নম্র। মেহমানদের সাথে তাদের আচরণ খুবই অমায়িক। সমুদ্র কাছে থাকার কারণে আবহাওয়া জলীয় বাষ্পপূর্ণ অর্থাৎ এখানকার বাতাসে আর্দ্রতার মাত্রা একটু বেশি হলেও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বেশ কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। সবমিলিয়ে গ্রীষ্মে প্রচণ্ড গরমে যখন সবার প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে যায় তখন অনেকেই এই এলাকায় ছুটে যায় একটু স্বস্তির নিশ্বাস নেয়ার জন্যে।
ইরানের উত্তরাঞ্চলীয় যে কয়েকটি এলাকা গরমের সময় মানুষকে শীতল প্রশান্তিময় আবহাওয়ার নিশ্চয়তা দেয় সেগুলোর মাঝে এই রমসার একটি। না কেবল ইরানের বিভিন্ন এলাকা থেকেই যে লোকজন এইসব এলাকায় বেড়াতে যায় তা নয়, বরং বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকেও অনেকেই এখানে আসেন রিফ্রেশমেন্টের জন্যে কয়েকটা দিন কাটিয়ে যেতে। তবে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর অতিথিই বেশি থাকে তুলনামূলকভাবে।
রমসার শহরের আরেকটি বিস্ময়কর প্রাকৃতিক উপহার হচ্ছে খনিজ গরম পানির ঝর্ণা। এরকম অন্তত আটটি গরম পানির ঝর্না আছে রমসারে। এইসব ঝর্নায় সিক্ত হবার জন্যে প্রায় সারা বছর ধরেই ইরান এবং ইরানের বাইরে থেকে বহু মানুষ এখানে বেড়াতে আসেন। এখানকার খনিজ গরম পানির কিছু কিছু ওষুধি গুণ রয়েছে। বিশেষ করে ত্বরে বিভিন্ন রোগের খুব ভালো উপকার হয় এখানকার পানির সাহায্যে। মানুষের ব্যাপক আনাগোণার কারণে এই শহরে গড়ে উঠেছে অনেক হোটেল। হোটেলগুলোও বেশ সুন্দর এবং আকর্ষণীয়। পুরোণো এবং নতুন করে গড়ে ওঠা হোটেলগুলো নিঃসন্দেহে শহরের সৌন্দর্যকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

রমসারের প্রাচীন হোটেল ভবনটি এখন একটি ঐতিহাসিক স্থাপনায় পরিণত হয়েছে। এই স্থাপনাটিকে বানানো হয়েছে যাদুঘর। ভবনটির যে স্থাপত্যশৈলী তা যে-কোনো দর্শককে খুব সহজেই আকৃষ্ট করবে। রমসার হোটেলটি গড়ে উঠেছে বন-বনানী, পাহাড় আর সমুদ্রের মাঝখানে। কী অদ্ভুত একটা ব্যাপার, তাই না! প্রকৃতির যেরকম স্বাদে আপনি অভ্যস্ত ঠিক সেরকম স্বাদই আপনি গ্রহণ করতে পারেন এই হোটেল থেকে। অ্যাতো বিচিত্র প্রাকৃতিক সুষমার একত্র সমন্বয় খুব কমই লক্ষ্য করা যাবে পৃথিবীতে। প্রাচীন এই হোটেলটির সামনে রয়েছে ত্রিশ হেক্টর পরিমাণ বনাঞ্চল। আবার হোটেলের পাশ দিয়েই চলে গেছে প্রশস্ত সড়ক। সবমিলিয়ে হোটেলটিকে দিয়েছে অনন্য সৌন্দর্য।
হোটেলটির ফাউন্ডেশন পাঁচ হাজার বর্গ মিটার ভূমির ওপর গড়ে উঠেছে। তিন তলা বিশিষ্ট এই হোটেলটি। নির্মাণ শৈলীগত দিক থেকে, সৌন্দর্যের দিক থেকে এবং অবস্থানগত দিক থেকে যে আকর্ষণ সৃষ্টি করেছে তা সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের হোটেলগুলোর মধ্যে তাকে শ্রেষ্ঠতম একটির মর্যাদা দিয়েছে। হোটেলটির প্রথম তলা হলো অতিথিদের বিশ্রামাগার। দ্বিতীয় তলা হলো খাবারের রেস্টুরেন্ট এবং অভ্যর্থনা কক্ষ। আর তৃতীয় তলায় রয়েছে থাকার জন্যে সুসজ্জিত কক্ষ। রমসার প্রাচীন হোটেলটি এতোসব গুণবৈশিষ্ট্যের কারণে ইরানের জাতীয় ঐতিহ্যের তালিকার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
রমসারের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো এখানে রয়েছে অসংখ্য পল্লীগ্রাম। শহর থেকে খুব একটা দূরে বলা যাবে না এই গ্রামগুলোর অবস্থান। শহরের কাছে হবার কারণে গ্রামগুলো শহরের জন্যে সৌন্দর্যের আলাদা একটা উপকরণ হয়েছে। ‘জাওয়াহের দেহ’ এরকম একটি নামকরা গ্রাম। সবুজ জঙ্গলাকীর্ণ এই গ্রামটির রয়েছে বেশ প্রাচীন ইতিহাস। শীতকালে এই গ্রামটিতে প্রচুর বরফ জমে। গরমের সময় সেই বরফ গলে গিয়ে সবুজের এক শীতল পরিবেশ সৃষ্টি করে। এই শীতল আবহাওয়া গরমের সময় যে কী পরিমাণ উপভোগ্য, তা সেখানে না গেলে উপলব্ধি করা দুষ্কর।
রমসারে দেখার মতো আরো অনেক কিছু আছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে অদিনে মসজিদ, চেহেল শহীদ কবরস্থান, মরকূহ কেল্লা, বান্দ্ কেল্লাসহ আরো বহু স্থাপনা। আপনারা তো এতোক্ষণ কেবল রমসারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথাই শুনলেন। রমসার কিন্তু কৃষিপ্রধান একটি এলাকাও। এখানে চা, ধানসহ দানাদার বিচিত্র শস্য প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হয়। পুরো রমসারের অর্থনীতির বেশিরভাগই নির্ভর করে এখানকার কৃষিপণ্য উৎপাদনের ওপর। কৃষিকাজের পাশাপাশি রেশম চাষ, মধুর চাষ, পশুপালন, মাছ শিকার, ফুলের চাষ, গালিচা বোণা ইত্যাদি বিচিত্ররকম পেশার কাজও রমসারে বিদ্যমান।#
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/৩০
খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন