আগস্ট ০২, ২০১৮ ১৭:১৪ Asia/Dhaka
  • দেখব ঘুরে ইরান এবার: নূরশহরের হৃদয়জুড়ানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য

নূর উপশহরের উত্তর দিকে রয়েছে কাস্পিয়ান সাগর। পূর্বদিকে রয়েছে অমোল শহর। নূরে’র দক্ষিণ দিকে রয়েছে আলবোর্য পর্বতমালা এবং লারিজান শহর আর পশ্চিমে রয়েছে নুশাহর উপশহর।

নূর শহরটির নাম আগে ছিল অন্যরকম। সোলদেহ নামে ডাকা হতো এই শহরটিকে। মযান্দারন প্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলীয় শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পুরোণো শহর ছিল এই ‘নূর’। এই এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ একেবারে অনন্য বলা যায়। প্রাকৃতিক এই সৌন্দর্যের কারণে এলাকাটি বিশেষভাবে গুরুত্বের দাবিদার। এই দাবি কতোটা বাস্তব তা এখানকার কেল্লা এবং উন্নত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পর্যালোচনার মাধ্যমে সহজেই বোঝা যায়।

নূর উপশহরের অর্থনীতি নির্ভর করে কৃষিকাজ এবং পশুপালন পেশার ওপর। নূর এলাকার বেশিরভাগ জনগণ এই দুই পেশার কোনো না কোনোটির সাথে জড়িত। কৃষিকাজ বা পশুপালনের আয় রোজগার থেকেই তারা তাদের জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। এ অঞ্চলে যেসব কৃষিপণ্য উৎপন্ন হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো কমলা জাতীয় বিভিন্ন রকমের ফল, ধান, গম, যব এবং আলু। নূরের পার্বত্য উপকূল এবং এখানকার বিস্তীর্ণ পাদদেশে রয়েছে ঘাস আর উদ্ভিদময় চারণভূমি। এই চারণভূমি থাকার ফলেই এখানে পশুপালনের সুবিধাটি তৈরি হয়েছে। পশু চরানোর জন্যে নূর এলাকাটি বেশ প্রসিদ্ধি পেয়েছে।

নূর এলাকায় রয়েছে ঐতিহাসিক বহু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। পর্যটক আকর্ষণীয় বহু নিদর্শনও রয়েছে এখানে। পবিত্র অনেক স্থাপনা যেমন রয়েছে নূর অঞ্চলে, তেমনি ঐতিহাসিক বহু কেল্লা বা দূর্গও রয়েছে। এরকম একটি দূর্গ হচ্ছে নূর কেল্লা। বালদা এলাকায় পড়েছে কেল্লাটি। আরো রয়েছে তেমিশান প্রাসাদ, বিশাল সমুদ্র সৈকত, নূর পার্কের মতো মন কেড়ে নেওয়া বহু প্রাকৃতিক দৃশ্যও। এ এলাকার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া। এই মনোরম আবহাওয়া নূরের দিকে টানে সবাইকে।

নূর পার্কের কথা বলছিলাম। এই পার্কটি আসলে একটি বন। বিচিত্র গাছ গাছালিতে ভরা বিশাল একটি উদ্যান। এই উদ্যানে রয়েছে পৃথিবীব্যাপী পরিচিত এবং সমাদৃত অনন্য বৃক্ষের সমাহার। এই বৃক্ষটির নাম হলো ‘সেফিদ প্লাত’। যারা প্রকৃতিপ্রেমী, তাদের কাছে এই বৃক্ষটি ভীষণ আদরণীয়। সে কারণেই দেশী বিদেশী পর্যটক শুধু নয় বরং বৃক্ষপ্রেমীরা বা প্রকৃতিপ্রেমীরাও এই ‘সেফিদ প্লাতের’ আকর্ষণে মুগ্ধ। নূর গার্ডেনটির আয়তন চার হাজার হেক্টরের মতো। নূর শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটারের মতো দূরত্বে সমুদ্রের তীর ঘেঁষে এই গার্ডেনটি গড়ে উঠেছে।

নূরের বুনো পরিবেশ ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই সবার কাছে ভালো লাগার বিষয়। উত্তরাঞ্চলীয় ইরানের বিস্তৃত এলাকা জুড়ে এর অবস্থান। এখানে প্রায় সারা বছর ধরেই মোটামুটি সকল মৌসুমেই লোকজনের ভীড় লেগে থাকে। ছুটির অবসরে বেড়ানোর জন্যে, কেউবা পর্যটনের উদ্দেশ্যে আবার অনেক প্রকৃতিপ্রেমী বা গবেষকও এখানে বেড়াতে আসেন। সবার ভালো লাগে এখানে, কেননা পুরো পরিবেশটাই ভালো লাগার মতো। এখানে দুর্লভ কিছু উদ্ভিদের অস্তিত্বও রয়েছে। প্রকৃতি গবেষকগণ তাই সেইসব উদ্ভিদকে সংরক্ষণ করার জন্যে চেষ্টা করে এসেছেন। যার ফলে নূর বনাঞ্চলটি এখন ব্যতিক্রমধর্মী বিচিত্র উদ্ভিদ সংরক্ষণের জন্যেও বেশ খ্যাতিময়। ওষুধি বৃক্ষও এখানে প্রচুর। এখানকার ওষুধি বৃক্ষ বা এগুলোর ভেষজ গুণবৈশিষ্ট্যের কারণে এগুলোর আর্থিক মূল্যও প্রচুর। এ এলাকায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণও একেবারে কম নয়।

এতোক্ষণ ধরে নূরের যে বর্ণনা বা বৈশিষ্ট্যের কথা বললাম তাতে নিশ্চয়ই বুঝতে বাকি থাকার কথা নয় যে সময় কাটানোর জন্যে, বেড়ানোর জন্যে এ এলাকাটি খুবই উপযোগী। তাছাড়া অতিথি আপ্যঅয়নের জন্যে যতো ধরনের ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন সবই এখানে করা হয়েছে। রাস্তা-ঘাট, হোটেল, থাকা, খাওয়াসহ বিনোদনের সকল আয়োজনই এখানে রয়েছে। রয়েছে ধর্মীয় স্থাপনা এবং চিকিৎসার সুন্দর ব্যবস্থাও। যারাই সেখানে বেড়াতে যায় তাদের সবাই এখানকার সুন্দর ব্যবস্থাপনার প্রশংসা না করে পারে না। জঙ্গলের কারণে এলাকার সবুজ শ্যামল সৌন্দর্য যেমন আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে তেমনি এখানকার জঙ্গলে বসবাসরত বিভিন্ন পশুপাখি দেখার সুযোগও রয়েছে ভ্রমণকারীদের জন্যে।

নূর এলাকায় একটি নামকরা গ্রাম আছে। গ্রামের নাম হলো ‘ইউশ’। ইউশের এতো নামডাক থাকার কারণ হলো এই গ্রামের নামটির সাথে ইরানের অন্যতম প্রধান কবি ‘নিমা ইউশিচের’ নামের মিল রয়েছে।  এই গ্রামটির ইতিহাস বেশ প্রাচীন। সেই সাসানীয় শাসনামলে গড়ে উঠেছিল গ্রামটি। ইউশ গ্রামটির আবহাওয়াও বেশ উপভোগ্য। গরমের সময় আবহাওয়া থাকে নাতিশীতোষ্ণ আর শীতের সময় বেশ ঠাণ্ডা। এখানে বরফও পড়ে ভালোই।

বালাদে শহর ইউশ থেকে সাত কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ইউশের জনগণের জন্যে এই বাজারটিই ব্যবসা বাণিজ্য বা কেনাকাটার জন্যে সবচেয়ে কাছে। গ্রামবাসীরা যেসব কৃশিপণ্য উৎপন্ন করে, পশুপালন করে যেসব পণ্যসামগ্রী উৎপাদন করে সেসব সামগ্রী তারা এই বাজারেই নিয়ে আসে। আবার বেচাকেনা শেষে এই বাজার থেকেই সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করে। ইউশ গ্রামটিতে প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী বহু ভবনের পাশাপাশি ঐতিহাসিক অনেক নিদর্শনও রয়েছে। কিয়দাউদ অগ্নিমণ্ডপ, জামে মসজিদ, সাইয়্যেদ আমিন এবং সাইয়্যেদ জালাল সমাধি, প্রাচীন হাম্মাম এবং নিমা ইউশিচ ভবন ইত্যাদি এখানকার দেখার মতো কিছু স্থাপনা।

এ সবের বাইরেও ইউশের সৌন্দর্য এবং সেখানকার মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য ইউশের আকর্ষণ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এই গ্রামের পথেই ঐতিহাসিক বালদেহ কেল্লাটি পড়ে। এই কেল্লাটি দেখার জন্যে দর্শনার্থীদের ভিড় লেগেই থাকে। ‘নিমা ইউশিজ’ আসলেই খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা। এই ভবনটির আয়তন  সাত শ’ বর্গমিটার। মাঝখানে উঠোন রেখে চারপাশে বিভিন্ন কক্ষ নির্মাণ করা হয়েছে। নির্মাণের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে ইট, চকসহ কাজারি শাসনামলের ভবন সজ্জার নানা উপাদান। মযান্দারনের ‘পর্যটন, হস্তশিল্প ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংস্থা’র উদ্যোগে এই ভবনটিকে এখন যাদুঘরে পরিণত করা হয়েছে।

এই এলাকার একজন বিখ্যাত কবির কথা বলে পরিসমাপ্তি টানবো আজকের আসরের। বিখ্যাত এই কবি হলেন আলি এস্ফান্দিয়রি। তিনি অবশ্য ‘নিমা ইউশিজ’ নামেই বেশিরভাগ পরিচিত। ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইউশ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন ইব্রাহিম খান আজামুস সুলতানা। মযান্দারনের একটি ঐতিহ্যবাহী পরিবার ছিল তাঁদের। নব্য ফার্সি কবিতার প্রবর্তক বলা হয় তাঁকে।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/০২

খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন