‘চলো চলো আরাকান চলো’ শ্লোগানে প্রকম্পিত কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবির
‘চলো চলো আরাকান চলো’ শ্লোগানে সোচ্চার হয়ে কক্সবাজারের আশ্রিত রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় নিজ দেশ মিয়ানমারের আরাকান (রাখাইন) রাজ্যে ফিরে যাবার দাবিতে আজ (রবিবার) সকালে মানববন্ধন কর্মসূচির আয়োজন করেছে।
কক্সবাজার সীমান্তবর্তী ৩৪টি শিবিরে আশ্রিত রোহিঙ্গারা আজ সকাল থেকে প্রবল বর্ষণ উপেক্ষা করেই শিবিরের বাইরে এসে সকাল ৯টা থেকে ১০টা পর্যন্ত একঘণ্টার ‘গো হোম’ কর্মসূচিতে অংশ নেয়। এ সময় আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য রোহিঙ্গারা নানা শ্লোগান সম্বলিত প্ল্যাকার্ড বহন করেছেন। ইংরেজিতে লেখা ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস, উই ওয়ান্ট রাইটস, উই ওয়ান্ট টু গো ব্যাক টু আওয়ার মাদারল্যান্ড’সহ বিভিন্ন দাবি দাবি তুলেছেন অংশগ্রহণকারীরা।
রোহিঙ্গাদের আজকের কর্মসূচি প্রসঙ্গে কক্সবাজারস্থ শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন বিষয়ক অতিরিক্ত কমিশনার মোঃ সামসুদ্দোজা রেডিও তেহরানকে বলেন, রোহিঙ্গারা তাদের নিজ দেশে ফেরত যেতে চায়, এটা আন্তর্জাতিক মহলকে জানান দিতেই তারা নিজ উদ্যোগে ‘গো হোম” কর্মসূচি পালন করেছে।
প্রতি বছর রোহিঙ্গারা প্রত্যাবাসন ও অধিকার নিয়ে গণজমায়েত, মানববন্ধন ও সমাবেশের নেপথ্যে একাধিক সংগঠন আয়োজন করলেও এবারের মানববন্ধনের আয়োজনে কোনো সংগঠনের নেতৃত্ব ছিল না বলে জানায় রোহিঙ্গারা। তারা নিজেরা নিজেদের অধিকার আদায়ে যার যার মতো ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিটি ক্যাম্পে মানববন্ধন করেছে বলে জানায়।
মানব বন্ধনে কুতুপালং ক্যাম্পের শিক্ষক সলিম উল্লাহ বলেন, “গত ৫ বছর ধরে আমরা শরণার্থী হয়ে বাংলাদেশে রয়েছি। মিয়ানমার আমাদের মাতৃভূমি, আমরা আমাদের জন্মভূমিতে ফিরতে চাই। মিয়ানমারে বসবাসরত ১৩৫ জাতির মতো ওই সরকার আমাদের যেন স্বীকৃতি দেয়। আমাদের যেন নিরাপত্তা দেয় এবং জাতিসংঘসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দেশ ও সংগঠনের সঙ্গে বসে সঠিক পন্থায় আমাদের ফিরিয়ে নেয়। আমাদের দাবি মেনে নিয়ে, রোহিঙ্গা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে নিজ দেশে বসবাস করার অধিকার দেয় সেজন্য আমরা সব ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা মানববন্ধন করছি।"
রোহিঙ্গাদের একটি বিক্ষোভ মিছিল ২৭নং ক্যাম্প থেকে শুরু হয়ে ক্যাম্পের প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে ২৬ নং ক্যাম্প ইনচার্জ (সিআইসি) অফিস চত্বরে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন। এতে ২৭ নং ক্যাম্পের মাস্টার ফায়সাল লিখিত বক্তব্যে বলেন, “রোহিঙ্গারা মিয়ানমার নির্যাতিত রোহিঙ্গা মুসলিম জনগণ। এখন জোরপূর্বক রাষ্ট্রহীন মানুষ। ২০১৭ সালের দেশত্যাগের পর পাঁচ বছর কেটে গেছে। আর কত দিন গৃহহীন থাকব? আমরা গৃহহীন থাকতে চাই না। আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। স্বদেশ মিয়ানমার নিজেদের মাতৃভূমি আরাকানে ফিরে যেতে চাই এবং সেখানে যথাযথ অধিকার নিয়ে নাগরিক হিসেবে বসবাস করতে চাই।”
তিনি বলেন, “রোহিঙ্গারা দীর্ঘকাল মিয়ানমারে নিপীড়নের শিকার হয়ে আসছে। ১৯৭৮ সাল থেকে রোহিঙ্গা মুসলিমরা নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যার শিকার। বিভিন্ন সময়ে গ্রাম ও বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয়েছে। ১৯৭৮, ১৯৯২, ২০১২, ২০১৬-এর ঘটনাসহ একাধিকবার মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করা হয়। শুধুমাত্র ২০১৭ সালের গণহত্যার সময় প্রায় ১.১ মিলিয়ন রোহিঙ্গা মানুষ মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।”
এসময় বাংলাদেশ সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ প্রকাশ করে তিনি আরো বলেন, “মানবিক ভিত্তিতে আমাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের (জিওবি) আমাদের খাদ্য, আশ্রয় এবং অন্যান্য সহায়তা প্রদানের জন্য আমরা জাতিসংঘ এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছেও কৃতজ্ঞতা জানাই। কিন্তু, বাংলাদেশ আমাদের দেশ নয়। আমরা মাতৃভূমি মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাই। ২০১৭-২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সহায়তায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে বেশ কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু, আজ পর্যন্ত আমাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে দৃশ্যমান ও কার্যকর কোনো অগ্রগতি হয়নি।
দীর্ঘদিন ধরেই দেশে ফিরে যেতে ইচ্ছুক রোহিঙ্গাদের বাধা দিয়ে আসছে রোহিঙ্গাদের কিছু সন্ত্রাসী বাহিনী। এ কারণে শিবিরগুলো দেশে ফিরতে ইচ্ছুক এবং ফিরতে বাধাদানকারী- এ দুই বিবাদমান গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। অভিযোগ রয়েছে, রোহিঙ্গাদের নিয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করা এবং রোহিঙ্গাদের দীর্ঘমেয়াদে এখানে রেখে ফায়দা আদায়ে নেপথ্যে কাজ করছে আন্তর্জাতিক কিছু সংস্থার কর্মী। সেইসঙ্গে দেশি-বিদেশি এনজিওকর্মীদের বিরুদ্ধেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাধা দেওয়ার অভিযোগ করেছেন খোদ সাধারণ রোহিঙ্গারাই। ‘গো হোম’ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের অনেকেই বলেছেন, দেশি-বিদেশি ইন্ধন না থাকলে অনেক আগেই আশ্রিত রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফিরে যাওয়ার কর্মসূচি বাস্তবায়িত হতো।
দেশে ফিরে যেতে ইচ্ছুক রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ জাফর এ বিষয়ে জানান, স্বদেশে ফিরতে বাধাদানকারী রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের প্রচণ্ড চাপ উপেক্ষা করেই আমরা আজকের 'গো হোম' কর্মসূচির আয়োজন করেছি। আমরা সন্ত্রাসীদের অস্ত্রকে আর ভয় পাই না। আমরা ফিরতে চাই শত বছরের আমাদের বাপ-দাদার ঐতিহ্যবাহী বাড়িভিটায়।
রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার ত্বোহা বলেন, ‘আমরা অবশ্যই মিয়ানমারে ফিরতে চাই। আমাদের রোহিঙ্গা হিসেবে মেনে নিলে আমরা মিয়ানমারে চলে যাবো। আমাদের নিরাপত্তা দিয়ে ফেরত নিতে হবে। আমরা আমাদের ক্ষতিপূরণ চাই এবং আমাদের মা-বোনদের যেভাবে অত্যাচার করেছে সে বিচারও চাই। এখানে আমরা কষ্ট পাচ্ছি। স্বাধীনতা পাচ্ছি না। তাই নিজ দেশে ফিরতে আমরা একতাবদ্ধ হয়েছি।’#
পার্সটুডে/আবদুর রহমান খান/আশরাফুর রহমান/১৯
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।