মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি- ৭১: নয়া উপনিবেশবাদ
“দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উপনিবেশবাদের নয়া রূপ দেখা দিল, এর নাম নয়া উপনিবেশবাদ।
নয়া উপনিবেশবাদী নীতি অনুযায়ী পিছিয়ে পড়া বা পেছনে ফেলে রাখা দেশগুলো বাহ্যিক দৃষ্টিতে রাজনৈতিকভাবে স্বাধীনতা লাভ করলেও অর্থনৈতিক দিক থেকে ছিল উপনিবেশবাদের কাছে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা।”
প্রকৃত অর্থেই মুসলিম দেশগুলো ইতিহাসের কাল পরিক্রমায় নিজেদের ভেতরের এবং বাইরের বহু ঘটনা দুর্ঘটনার সম্মুখিন হয়েছে। এগুলো সমাজে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক চিন্তা চেতনাগত বিকাশ ও উন্নয়নে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। আমরা ইতোমধ্যেই সেসব নিয়ে কিছু কিছু আলোকপাত ও ব্যাখ্যা করার চেষ্টাও করেছি। কিন্তু কোনো কোনো বিশ্লেষকের অভিমত হচ্ছে মুসলিম উম্মাহর বর্তমান এই পশ্চাদপদতা বা পেছনে পড়ে থাকার মূল কারণ হলো পশ্চিমা উপনিবেশবাদ। উপনিবেশবাদী পাশ্চাত্য সকল ক্ষেত্রেই তাদের আধিপত্য বিস্তার করে রাখাটাই মুসলিমদের এই অনগ্ররতার মূল কারণ। মুসলিম দেশগুলোর অগ্রগতি ও উন্নতি পথে মারাত্মক বিঘ্ন সৃষ্টিকারী এই উপনিবেশবাদের বিভিন্ন দিকের প্রতি খানিকটা নজর বুলানো প্রয়োজন।

খ্রিষ্টিয় পণর শতকের পর থেকে আমরা পশ্চিমা শক্তিগুলোর উত্থান লক্ষ্য করবো। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোর প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করার ব্রত নিয়ে তারা বিভিন্ন দেশকে তাদের উপনিবেশবাদের ক্রীড়ণক হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। তাদের সরাসরি উপনিবেশ যেসব দেশে প্রতিষ্ঠিত ছিল ঠিক সেরকমভাবেই এসব দেশকে পরিণত করেছে তারা।
অনেকে মনে করেন উপনিবেশবাদের ইতিহাস আরো অনেক পুরোণো। আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপে রোমান সাম্রাজ্য সেই উপনিবেশবাদেরই নামান্তর মাত্র ছিল। তবে সরাসরি উপনিবেশবাদ বলতে যাদের বোঝায় তাদের উত্থান শুরু হয়েছিলো সেই পণর শতকের সূচনাতেই। সেই সময়কার শক্তিশালী দেশ বলতে ছিল পর্তুগাল, হল্যান্ড, ফ্রান্স, ব্রিটেন এবং স্পেন বিশ্বের বিভিন্ন মহাদেশ যেমন আফ্রিকায়, এশিয়ায় এবং উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় তাদের উপনিবেশ স্থাপন করেছিল।
পশ্চিমা উপনিবেশবাদীরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রচার করতো যে, বিশ্বের কিছু কিছু দেশ আছে সভ্যতা থেকে অনেক দূরে তাদের অবস্থান। তাই এসব দেশকে সুসভ্য ও উন্নত করে তোলা তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত। এ কথা বলে তারা সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সংস্কৃতি ও সভ্যতা এবং শিক্ষা ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দিয়ে সেগুলোর পরিবর্তে তাদের নিজেদের শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালাতো। সে সময় যেহেতু ইউরোপীয়রা জাহাজ নির্মাণ এবং সমুদ্র যাত্রার ক্ষেত্রে অগ্রগতি লাভ করেছিল, সেহেতু তারা সমুদ্র পথের নির্দেশনা পেয়ে নতুন নতুন দেশ আবিষ্কার করতে পেরেছিল। তারি সুবাদে তারা পৃথিবীব্যাপী তাদের শাসন ব্যবস্থার বিস্তার ঘটাতে পেরেছিল।
উপনিবেশবাদীরা বিভিন্ন দেশের ওপর তাদের আধিপত্য বিস্তার করার সুবিধার্থে দেশগুলোর অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক অঙ্গনের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছিল। রাজনৈতিক উপনিবেশিকতাকে আরেক দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বিদেশী হস্তক্ষেপ বলে উল্লেখ করা যেতে পারে। কেননা সংশ্লিষ্ট দেশটিকে ঔপনিবেশিক শক্তির চিন্তা চেতনা বা সহজভাবে বললে তাদের চাওয়া পাওয়ার কাছে নতি স্বীকার করে চলতে হয়। উপনিবেশবাদীদের প্রবেশ বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে তাদের প্রবেশ কিন্তু একেবারে সহজে ঘটে নি। তারা প্রথমে তাদের সামরিক বাহিনীর সহযোগিতায় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে নিজেদের ঘাঁটি গড়ে তুলেছিল। কেন্দ্রিয় শাসনব্যবস্থা যদি উপনিবেশবাদীদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যেত তাহলেই তাদের সেনাবাহিনীর হুমকির মুখে পড়তে হতো। রাজনৈতিক উপনিবেশিকতা ছিল মানবিক এবং প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর আধিপত্য বিস্তারের ভূমিকাস্বরূপ। এই পথ ধরেই তারা দেশগুলোর পণ্যের বাজারে, কাঁচামালের ক্ষেত্রে, পুঁজি বিনিয়োগের সুযোগ লাভের ক্ষেত্রে, সামরিক ঘাঁটিগুলোতে হস্তক্ষেপ তথা ঢুকে পড়ার মাধ্যমে দেশগুলোর জনশক্তিতে পরিণত হতো।
এভাবেই উপনিবেশিকতার সর্বপ্রথম পর্যায়ে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের মতো ইউরোপীয় সমুদ্র অভিযাত্রীগণ যাত্রা শুরু করে ১৭৬০ সাল পর্যন্ত অব্যাহত রেখেছিল। এই পর্বে আমেরিকা উপমহাদেশের বেশিরভাগ এলাকা সামরিকভাবে কিংবা অভিবাসনের মাধ্যমে ইউরোপীয়দের হাতে এসে যায় এবং এশিয়াতেও সর্বপ্রথম সাম্রাজ্যবাদী লুণ্ঠণ শুরু হয়ে যায়। এটা শুরু করেছিল ইউরোপীয় বণিক বা বিভিন্ন কোম্পানীর মাধ্যমে। এইসব কোম্পানী নিজেরাই কিংবা তাদের সরকারগুলোর সাথে যোগসাজশের মধ্য দিয়ে তাদের লুটতরাজ চালিয়েছিল।
দ্বিতীয় পর্বটি ১৭৬৩ সাল থেকে ১৮৭০ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এ সময় উপনিবেশিকদের বিকাশ কিছুটা রুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। এর কারণ ছিল ইউরোপীয়রা তাদের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছিল। এইসব দ্বন্দ্ব কখনো ন্যাশনালিজম কখনোবা লিবারেলিজম আবার অনেক ক্ষেত্রে শিল্প বিপ্লবকে ঘিরে আবর্তিত ছিল।
তৃতীয় পর্বটি ১৮৬০ সাল থেকে শুরু হয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত বিস্তৃত। এ সময়টা ছিল উপনিবেশিকতার বিকাশের সর্ববৃহৎ প্রবাহের সময়। দূরপ্রাচ্যের বিভিন্ন এলাকা এবং আফ্রিকায় এ সময় উপনিবেশিকতা তার পত্রপল্লব বিস্তার করেছিল। এই যুগটাতে শিল্পোন্নত দেশগুলো উপনিবেশ কবলিত দেশগুলোতে বাজার প্রতিষ্ঠা করে তাদের পণ্যসামগ্রী সরবরাহ করেছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উপনিবেশিকতার শক্তি ধীরে ধীরে স্তিমিত হতে থাকে। জাতীয়তাবোধে উজ্জীবিত জনতার বিপ্লবের মুখে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উপনিবেশবাদের পতন ঘটে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে উপনিবেশবাদীরা তাদের উপনিবেশগুলোতে সংঘটিত বিপ্লবকে আনুষ্ঠানিকভাবে মেনেও নিয়েছিল। কঙ্গো ছিল বেলজিয়ামের উপনিবেশ। বেলজিয়াম তাদের এই উপনিবেশটিকে সরাসরি নিজ দেশে বসেই নিয়ন্ত্রণ করতো। কিন্তু কঙ্গোর জনগণের আন্দোলনের মুখে বেলজিকরা তাদের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। ফ্রান্সও প্যারিসে বসেই তাদের উপনিবেশগুলো নিয়ন্ত্রণ করতো। ভারত চীন এবং আলজেরিয়ায় তাদের উপনিবেশ ছিল। এইসব দেশে যখন উপনিবেশবাদ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছিল তখন মার-দাঙ্গা, ক্ষয়ক্ষতির এক পর্যায়ে স্বাধীনতা লাভ করেছিল দেশগুলো।
সে সময় আরেকটি ঔপনিবেশিক শক্তি ছিল বৃটেন। ব্রিটিশরাও প্রথম প্রথম ভারতের মতো তাদের উপনিবেশকে তাদেরই দায়িত্বশীলদের মাধ্যমে শাসন করেছিল। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়া পর্যন্ত আস্তে আস্তে ভারতীয়রা তাদের নিজেদের দেশ নিজেরাই শাসন করার চিন্তায় অগ্রসর হয়। এই চিন্তায় অগ্রসর হয়ে তারা স্বাধীনতা লাভ করে।
আরো এক ধরনের উপনিবেশবাদ ছিল সাংস্কৃতিক। এটা ছিল কোনো একটি দেশের সমাজকে অপর কোনো দেশের সংস্কৃতি মেনে নিতে বাধ্য করা। এই উপনিবেশিকতা থেকেই ইউরোপে উৎপত্তি হয়েছে মার্কেন্টাইলিজমের।#
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবু সাঈদ/ ১